পদোন্নতি হলেও হয়নি পদের উন্নতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চাকরিজীবীদের জন্য পদোন্নতি একটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়। সেটা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একইভাবে প্রযোজ্য। আর যেকোনো প্রতিষ্ঠান পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয় তাদের চাহিদার ভিত্তিতে। পদোন্নতি দেওয়া হয় সবচেয়ে দক্ষ, উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের। চাকরিরতদের মনোবল ধরে রাখতে অভিজ্ঞতাকে পদোন্নতির একটি পরিমাপক হিসেবে নেওয়া হয়। তাই দক্ষ হলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাই আগে বিবেচিত হন পদোন্নতির তালিকায়। এতে সমৃদ্ধ হয় প্রতিষ্ঠানটি। অনুপ্রেরণা পান দক্ষ ব্যক্তিরা। যাঁদের পদোন্নতির সময় এখনো আসেনি, তাঁরাও নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য হন সক্রিয়।
এমনটাই চলে আসছিল বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও। তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে পদোন্নতি বিবেচনায় দলীয় আনুগত্যকে অলিখিতভাবে একটি নিয়ামক হিসেবে ধরা হতে থাকে। তবে সব ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। কিন্তু বলা যাবে যে দলীয় বিবেচনায় এ সময় অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বাদ পড়েছেন সময়োচিত পদোন্নতি থেকে। অন্যদিকে দলের সমর্থক সেজে তুলনামূলকভাবে কম যোগ্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে অদক্ষ কর্মকর্তা ঠাঁই করে নিচ্ছেন পদোন্নতির তালিকায়। ১৯৯১ সাল থেকে হালনাগাদ সব রাজনৈতিক সরকারই এ কাজ করেছে এবং করে চলছে।
আরেকটি নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে পদোন্নতির প্রক্রিয়ায়। এটা সবার জানা যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাচে একসঙ্গে অনেক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে তাঁদের সবাইকে ওপরের স্তরে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। একসঙ্গে কিংবা ভেঙে ভেঙেও নয়। এরূপ দেওয়া হলে পরবর্তী ব্যাচের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু তা-ই করা হচ্ছে পদোন্নতির প্রক্রিয়ায়। আর করতে গিয়ে নির্ধারিত পদসংখ্যার ধার না ধেরে ঢালাওভাবে দেওয়া হচ্ছে পদোন্নতি। এর পরিণতি সম্পর্কে ভেবে এটা পরিহার করার কোনো প্রচেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। উল্লেখ্য, পদ ছাড়াই পদোন্নতির সূচনা হয় ২০০৬ সালের শেষ দিকে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা ত্যাগের কয়েক দিন আগে। তখন কোনো শূন্যপদ ছাড়াই প্রায় ৩০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় উপসচিব পদে।
২০০৭ সালে এক-এগারোর পরিবর্তনের পর অ্যাডহক ব্যবস্থা হিসেবে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য এসব পদোন্নতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সুপার নিউমেরারি উপসচিব পদ সৃজন ও তাঁদের পদায়ন করে শাখাকে অধিশাখায় রূপান্তর করা হয়। মনে করা হয়েছিল ব্যতিক্রমধর্মী এ ব্যবস্থা সাময়িক হবে। তবে ২০০৯ সালে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমে ধীরে এবং পরে ঢালাওভাবে এ ধরনের পদোন্নতি দিতে থাকে। পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি, পদ ছাড়া পদোন্নতি গিয়ে ঠেকেছে পদগুলোয় অতিরিক্ত সংখ্যক কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও আরও পদোন্নতিতে। এখন অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে নির্ধারিত ১০৭, ৪৩০ ও ৮৩০টি পদের বিপরীতে ‘কর্মরত’ আছেন যথাক্রমে ৪৫৭, ১১৬৬ ও ১৬২৩ জন কর্মকর্তা। তাঁদের কর্মরত বলতে হবে এই জন্য যে পদোন্নতি পাওয়া প্রায় সবাইকে নিজ পদে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ সংখ্যার মাঝে মাস দেড়েক আগে পদোন্নতি পাওয়া ২৩১, ২৯৯ ও ৩৪২ জন যথাক্রমে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব রয়েছেন। পদোন্নতিটি এর আগেই অতিরিক্তসংখ্যক কর্মকর্তা নির্ধারিত পদে থাকার পরও দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রের সূত্র দাবি করছে, সংখ্যায় এ এককালীন পদোন্নতি গত ছয় বছরে সর্ববৃহৎ।
এরূপ সংযুক্তির ফলে অতিরিক্ত সচিবের অধীনে ক্ষেত্রবিশেষে কাজ করছেন অতিরিক্ত সচিব। একই হাল যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের ক্ষেত্রেও। রুলস অব বিজনেস অনুসারে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবেরা অনুবিভাগ-প্রধান। অর্থাৎ যুগ্ম সচিবদের অতিরিক্ত সচিবের অধীনে কাজ করার কথা নয়। সেখানে একই পদধারীর অধীনে কাজ করছেন একই পর্যায়ের কর্মকর্তা। এর বৈধতা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। রুলস অব বিজনেস উপেক্ষা করার মতো বিষয় নয়। সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে সরকারের কাজ কীভাবে চলবে, তা এ বিধিমালায় নির্ধারিত। এতে সুস্পষ্ট রয়েছে অনুবিভাগ, অধিশাখা ও শাখার কাজ কীভাবে চলবে এবং কারা দায়িত্বে থাকবেন, এ সবকিছু। এর হেরফের যা করা হচ্ছে, তা সামান্য নয়। দু-চার মাসে কেটে যাওয়ারও কথা নয়। তাহলে বিষয়টি কীভাবে নিষ্পত্তি হয়, এটা দেখার বিষয়। উল্লেখ্য, পদোন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করে হঠাৎ বন্ধও করা যাবে না। আগে বঞ্চিত হওয়া বেশ কিছু কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠতার বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে আরও পদোন্নতি দেওয়ার দাবি আসবে। আর সে দাবি অযৌক্তিকও হবে না।
পদোন্নতির পর একজন কর্মকর্তার স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে তিনি উচ্চতর দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁর অফিসের স্থানসহ সর্বত্র পড়বে উন্নতির ছাপ। কিন্তু এমনটা তো হতে দেখা যাচ্ছে না। একটি অধিশাখায় কর্মরত উপসচিব তিন বছর আগে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে সেখানেই থাকেন। এবার তিনি হয়ে যান অতিরিক্ত সচিব। আছেন সেখানে। সব স্তরে এ ধরনের অবস্থান ব্যাপক। এর থেকে বেরিয়ে আসার যৌক্তিক রাস্তাই বা কোথায়, সেটাও সহজবোধ্য নয়। যতজন অতিরিক্ত সচিব এখন আছেন, তাঁদের অনুবিভাগ-প্রধান করা হলে যুগ্ম সচিবদের অধিশাখা নিয়েই থাকতে হবে। প্রায় ১ হাজার ৬০০ যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে সচিবালয় মর্যাদার সঙ্গে ধারণ করতে পারে না। প্রেষণেই বা এত পদ কোথায়? বিশেষায়িত পদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের না দিয়ে সব ক্ষেত্রে তাঁদের প্রেষণে দেওয়া অসংগত হবে। এতে একদিকে সে সংস্থায় পদোন্নতির সুযোগ হবে সংকুচিত, অন্যদিকে সরকারকে বিশেষায়িত পরামর্শ দেওয়ার দক্ষতাও হ্রাস পাবে। ফলে সরকারের কার্যক্রমে পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। আর অধিশাখাগুলোয় যদি যুগ্ম সচিবদের পদায়ন করা হয়, তবে উপসচিবদের শাখার দায়িত্ব নিয়েই থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে সহকারী সচিবদের পদায়নের সুযোগও থাকবে না।
এ ধরনের ঢালাও পদোন্নতির সপক্ষে বলা হচ্ছে, কর্মকর্তারা পদোন্নতির জন্য উপযুক্ততা অর্জন করেছেন। এর আগের স্তরে নির্ধারিত সময়সীমা পার করেছেন। পদোন্নতি না পেলে মনোবলে পড়বে ভাটা। কিন্তু পদ না থাকলেও কি শুধু এ কারণে পদোন্নতি দেওয়া যায়? অতিসম্প্রতি যে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কোনো কোনো ব্যাচকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করানো সংগত ছিল। চাকরি রয়েছে তাঁদের বেশ কিছু সময়। এ ধরনের পদোন্নতিতে কি তাঁরা সরকারকে অধিক সেবা দিতে পারবেন? বরং সরকারব্যবস্থায় একটা এলোমেলো পরিবেশ সেই সেবাদানের কার্যক্রমকে ব্যাহত করারই কথা। এ অবস্থায় সচিবেরা নিজেদের মন্ত্রণালয় কীভাবে সামলাচ্ছেন, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
একই ব্যাচের অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপসচিব রয়েছেন বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে। সংখ্যার অতিরিক্ত তো বটেই, কোথাও যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদের স্থানান্তর এবং ক্ষেত্রবিশেষে কক্ষান্তর করে বসার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে ঊর্ধ্বতনদের জন্য। নথি চলাচলের প্রক্রিয়াও হয়তোবা কোনোভাবে সমাধান দেওয়া হচ্ছে। এতে আর যা-ই হোক, প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ঈপ্সিত গতি আসার কথা নয়। আরও মনে হয়, এ ধরনের বড় সংখ্যায় পদোন্নতি তো থেমেও থাকবে না। পদ নেই বলে পদোন্নতির দাবিকে উপেক্ষা করার সুযোগ রইল কোথায়? আর যদি পদোন্নতি না-ও দেওয়া হয়, কত বছরে বর্তমানে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হবে, এটা হিসাব করে দেখা দরকার। তবে প্রকৃত প্রস্তাবে পদোন্নতির প্রক্রিয়া ন্যায়ত বন্ধ রাখা যাবে না।
যেটা ঘটার ঘটে গেছে। পিছু হটার সুযোগ নেই। তবে শুধু শূন্যপদে পদোন্নতির নিয়ম দ্রুত চালু করাই উত্তম। আর যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করার দায়িত্ব খসড়া সিভিল সার্ভিস আইনের বিধান অনুসরণে সরকারি কর্মকমিশনকে দেওয়াই সংগত। হয়তো সে খসড়াটি এখন পরিত্যক্ত। পাবলিক সার্ভিস আইনের খসড়া হয়েছে। নতুন খসড়ায় এ ধরনের বিধান সংযোজন একটি সময়ে সুফল দেবে। পদের উন্নতি ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার আবশ্যকতা তখন থাকবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
[email protected]