সু চির জন্মদিন ও লাঞ্ছিত নায়েক রাজ্জাক

অং সান সু চি, আবদুর রাজ্জাক
অং সান সু চি, আবদুর রাজ্জাক

সত্তরে পড়লেন প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিরোধী নেত্রী অং সান সু চি। সত্তর বছর মানুষের জীবনের এ রকম এক মাইলফলক, মানুষ যখন পেছনের দিকে তাকিয়ে সাফল্য আর ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশের আলোকে সামনের দিনগুলো নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবনা-চিন্তায় নিয়োজিত হয়। অনেকের বেলায় সত্তরে কর্মময় জীবনের সমাপ্তি সূচিত হলেও ব্যস্ত আর বিখ্যাত মানুষজন যে এরপরও আরও বেশ কিছু বছর সক্রিয় থাকেন, সেই প্রমাণ তো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আবার ক্ষমতার স্বাদ মানুষকে বয়সের ভার থেকেও মুক্ত রাখে। সু চির কর্মময় জীবনের বিস্তৃতি দীর্ঘ সময়জুড়ে হবে। তিনি ক্ষমতায় না গিয়েও ক্ষমতার স্বাদ ইতিমধ্যে অনুভব করতে শুরু করেছেন। অন্তত সত্তরতম জন্মদিনে প্রদত্ত তাঁর ভিডিও বিবৃতি থেকে সে রকম বার্তাই আমরা পাই।
সত্তরতম জন্মদিনে অং সান সু চির ঘটা করে বিশাল আকারের কেক কাটার ছবি পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেটে দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। জন্মদিনে এই কেক কাটার ছবি দেখলে আমরা বাংলাদেশিরা অবশ্য কিছুটা ভড়কে যাই। কেননা, আমাদের জীবনের বাস্তবতা এ রকম বার্তা আমাদের দেয় যে জন্মদিনের সেই রকম বিশাল আকারের কেকের নিচে অসত্যের অনেক ধুলা চাপা দেওয়া থাকে। তবে সু চির বেলায় সেটা হয়নি বলেই ধারণা করি। তারপরও ভিন্ন একটি কারণে সংশয়মুক্ত হওয়া হয়তো আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
আমরা জানি, সু চি যখন জন্মদিনে টেবিলজুড়ে কেক কাটছেন, তাঁরই দেশের অসহায় কিছু মানুষ তখন ক্ষুধার জ্বালা আর প্রাণের ভয়ে দেশান্তরিত। আর অসহায় সেই মানুষগুলো যে তাঁরই দেশের মানুষ, সেই সত্য অস্বীকার করবেন কীভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী? শুধু সেটুকুই নয়। ইন্টারনেট আর পত্রপত্রিকায় যেদিন সু চির জন্মদিনের কেক কাটার ছবি দেখার সুযোগ আমাদের হয়, সেই একই দিনে আরেকজন অসহায় মানুষের ছবিও আমরা দেখি, সু চির দেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় (মিয়ানমার নয়) দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকার অপরাধে দেশটি তাঁর সঙ্গে অপরাধীর মতো আচরণ করছে। জন্মদিনের কেক কাটার উৎসবে আমাদের সেই নায়েকের অসহায় পরিণতির কথা সু চির আদৌ মনে হয়নি এবং এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও তিনি করেননি। যদিও আমরা জানি, একজন বিবেকবান মানুষ হিসেবে অন্তত এ বিষয়ে কিছু একটা বলা তাঁর উচিত ছিল। তবে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর থাকার কারণেই তিনি এ বিষয়ে কিছু বলা থেকে বিরত আছেন? দেশটির সামরিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যদি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কোনো ফারক না থাকে, তাহলে আমাদের উদ্বিগ্ন হতে হয় বৈকি।
কোন পরিস্থিতিতে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছেন এবং আরেক সীমান্তরক্ষী, নায়েক আবদুর রাজ্জাক বন্দী হয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলেছে, তাদের টহল নৌকা বাংলাদেশ জলসীমায়ই ছিল। মিয়ানমার সীমান্ত পুলিশের (বিজিপি) দাবি, তারা তাদের জলসীমা থেকেই রাজ্জাককে আটক করেছে। সেটি যদি সত্যও হয়, বিজিবির সদস্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। দুই দেশের মধ্যে বিভক্তি রেখা টেনে দেওয়া নাফ নদীতে চোরাই পণ্যের লেনদেনের বিষয়টি সবার জানা। মনে পড়ে, ছাত্রজীবনে একবার শিক্ষাভ্রমণে সেই নাফ নদীর তীরে যাওয়ার সুযোগ যখন হয়েছিল, সেই সময়ও যে নদী দিয়ে চোরাই পণ্যের আদান-প্রদান হতো, তা আমাদের চোখ এড়ায়নি। এখন অবশ্য ইয়াবার মতো ক্ষতিকর মাদক আর অবৈধ অস্ত্র সেই পথে নিয়মিত আসছে বলে অভিযোগ আছে। ফলে সে রকম এক সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত টহল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সে রকম টহল দায়িত্ব পালন করছিলেন আমাদের নায়েক রাজ্জাক, মিয়ানমারের প্রতিপক্ষ যখন হঠাৎ তাঁর দলের একজনকে আহত করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে বলা যায় এ রকম নতুন এক খেলার শুরু, আন্তর্জাতিক কূটনীতির খুবই লজ্জাজনক এক লঙ্ঘনই যেটা কেবল নয়, বরং প্রচলিত সব রকম আইন তথা জেনেভা কনভেনশনেরও পরিপন্থী।

>আমরা চাই আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আপনি যেন দ্রুত পৌঁছে যেতে পারেন। কেননা, সেই সত্য আমাদের জানা আছে যে আপনার দেশের মানুষের জন্য সেটা হয়তো হবে একধরনের মুক্তি এবং আগামীর অভিজ্ঞতা হয়তো আপনাকে দেখিয়ে দেবে আজকের এই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসার পথ

নায়েক রাজ্জাকের যে ছবি মিয়ানমার প্রচার করেছে, সেখানে তাঁকে হাতকড়া পরা অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক আইনের কোনো সংজ্ঞাতেই প্রতিবেশী দেশের বন্দী এক সীমান্তরক্ষীকে হাতকড়া পরা অবস্থায় বসিয়ে রেখে ছবি তুলে নিয়ে তা বিশ্বজুড়ে প্রচার করার নিয়ম নেই। তবে দেশটির নৈতিক মানদণ্ড এখন এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার-বুদ্ধিও দেশের নীতিনির্ধারকেরা হারাতে বসেছেন।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে কোনো রকম প্রত্যাশা থাকা আমাদের উচিত নয়। কেননা, আমরা জানি সেই জান্তা
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের মানুষের সব রকম অধিকারই কেবল খর্ব করেনি, সেই সঙ্গে দমন–পীড়নের পর জনগণ থেকে প্রত্যাখ্যাত ও ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভোটের ফলাফল বানচাল করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। সে কারণেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা বিরোধী দলের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি আশা নিয়ে আমরা তাকিয়ে ছিলাম। কেননা, নীরব অথচ বলিষ্ঠ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জান্তার কুশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আদর্শ প্রতীক। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেছি, মনে মনে চেয়েছি তিনি যেন তাঁর সেই অসম যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেন এবং হয়েছেনও। ফলে তাঁকে নিয়ে আমাদের মধ্যে গভীর প্রত্যাশাও জেগেছিল। সেই প্রত্যাশা হলো, ন্যায় বোধের দ্যুতিময় স্ফুলিঙ্গে উদ্ভাসিত অং সান সুচি অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না।
জন্মদিন পালন করলেন তিনি খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে। আর এটা ঠিক তখন তিনি পালন করলেন, নিজের দেশের একটি জাতিগোষ্ঠী যখন নির্যাতনের স্টিমরোলারের চাপে পিষ্ট হয়ে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশের এক নাগরিককে যখন স্রেফ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অপরাধে হাতকড়া পরিয়ে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। আর এসব নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন আমাদের প্রত্যাশার সেই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।
না, জন্মদিনে আপনার জন্য অশুভ কোনো কামনা আমাদের নেই। আমরা চাই আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আপনি যেন দ্রুত পৌঁছে যেতে পারেন। কেননা, সেই সত্য আমাদের জানা আছে যে আপনার দেশের মানুষের জন্য সেটা হয়তো হবে একধরনের মুক্তি এবং আগামীর অভিজ্ঞতা হয়তো আপনাকে দেখিয়ে দেবে আজকের এই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসার পথ। ফলে আপনার দিকে বাড়িয়ে রেখেছি আমাদের ভালোবাসার হাত।
টোকিও, ২০ জুন ২০১৫
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷