আওয়ামী লীগ নিজেকে বদলাতে পেরেছে কি?

হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আজ বাংলাদেশে একটি শিশুর জন্ম হলে এটাই ধরে নেওয়া হবে যে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৬৮ বছর। চল্লিশের দশকে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল চল্লিশের নিচে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে।
এই টিকে থাকার সম্ভাবনা বা টেকসই হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি খুবই অনিশ্চিত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে। একটি দল হয়তো হঠাৎ গজিয়ে ওঠে। আবার কয়েক দিন পর তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দেশে সাইনবোর্ড আর প্যাডসর্বস্ব দলের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ব্যতিক্রম কেবল আওয়ামী লীগ। আজ তার ৬৭তম জন্মদিন। কালের বিবর্তনে টেকসই হয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। কাকতালীয় হলেও এ দেশের ইতিহাসে দিনটি উল্লেখযোগ্য। ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর আমবাগানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে হারিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা বাংলা দখল করে নিয়েছিল। ১৯৪৯ সালের এই দিনে যখন আওয়ামী লীগ ভূমিষ্ঠ হলো, তখন কে ভেবেছিল যে এই দলের হাত ধরে একদিন বাংলা মুক্ত হবে?
ঢাকার নবাবপুরে মুসলিম লীগের কর্মীরাই আওয়ামী লীগ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগকে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে আজকের এই দিনে ৬৬ বছর আগে ২৫০ থেকে ৩০০ প্রতিনিধির এক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৪০ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরি হলো। ‘আওয়ামী লীগ’ নামটা প্রস্তাব করেছিলেন মাওলানা ভাসানী। প্রথম কমিটির নির্বাহীদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ভাসানী (সভাপতি); আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ খান, আলী আমজাদ খান ও আবদুস সালাম খান (সহসভাপতি); শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক); শেখ মুজিবুর রহমান (যুগ্ম সম্পাদক); খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ কে এম রফিকুল হোসেন (সহসম্পাদক) এবং ইয়ার মোহাম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ)। শেখ মুজিব তখন ‘নিরাপত্তা আইনে’ জেলে আটক ছিলেন।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৩ সালে দলের প্রথম কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্রুত দেশের আনাচে–কানাচে সংগঠন গড়ে তোলে এবং ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ তখন শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ করেছিল। ফজলুল হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ক্ষমতার সম্মিলনে এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ধরাশায়ী হয়।
১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে একে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী দলের একটি অংশ নিয়ে বেরিয়ে যান এবং ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) নামে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। বলা যায়, তখন থেকেই আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ পথকে চার পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বটি ছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। মাঝে আওয়ামী লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস (১৯৫৬–৫৭ সালে) এবং প্রদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) কয়েক মেয়াদে প্রায় দুই বছর সরকার পরিচালনা করলেও বাকি সময় ছিল বিরোধী দলে। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা রূপরেখা ঘোষণা করলে এ দেশে রাজনীতির ব্যাকরণ আমূল পাল্টে যায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম হয়। একাত্তর সাল আমাদের সবচেয়ে আনন্দের, গৌরবের ক্ষণ এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে বেদনারও। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের সাধারণ মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। সংখ্যা দিয়ে তার গুরুত্ব নির্ধারণ করা যাবে না।
১৯৪৯-৭১ পর্বটি ছিল আমাদের একটি জাতি হিসেবে জেগে ওঠার সময়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থানপর্ব। একই সময়ে এটা ছিল শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠা। প্রচণ্ড ঘ্রাণশক্তি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রধান নেতা, আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাঁর হাত ধরে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার সিঁড়ি একটা একটা করে পার হয়েছিল।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বলা যায় আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় পর্ব। দলটি ইতিমধ্যে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। রাজপথের আন্দোলন থেকে পৌঁছে গেছে ক্ষমতার অন্দরমহলে। এই সাড়ে তিন বছরে দলটির অর্জন অনেক। আমরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটা সংবিধান পেলাম। বাংলাদেশ বিশ্বসভায় আপন মর্যাদায় স্বীকৃতি পেল। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামো নতুন করে তৈরি হলো। কিন্তু দেশ পড়ে গেল রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সহিংসতার চক্রে। দলটি ক্রমেই হয়ে উঠল অসহিষ্ণু। বাকশাল নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হলো। ‘সুশাসন’ ক্রমে নির্বাসিত হলো। দলের মধ্যকার চাটুকার ও বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা শেখ মুজিবকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। দেশটা যে তিন-চার বছরে অনেক বদলে গেছে, তিনি তা বুঝতেই পারেননি। এই সুযোগে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা পকেটে পুরে ফেলল। শেখ মুজিব সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন।
১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দলটি তৃতীয় পর্ব পার করল। রাজনীতি তখন প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সামরিক বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছিল। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ আবার দল গোছানো শুরু করে। তার পরও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছিল না। ১৯৮০ সালের মে মাসে শেখ হাসিনা দীর্ঘ প্রবাসজীবন ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং দলের হাল ধরেন। ফলে দলটি আবার কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ এ সময় যুগপৎ সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ক্ষমতার অংশীদার হওয়া—এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল নেয়।
১৯৯১ সালে এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় আওয়ামী লীগের চতুর্থ পর্ব। এই পর্বে আওয়ামী লীগ কখনো হয়েছে প্রধান বিরোধী দল, আবার কখনো এসেছে সরকারে। দলের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ৩৫ বছর পার করলেন। এটা দলকে যেমন ধারাবাহিকতা দিয়েছে, তেমনি সংকটও তৈরি করেছে। এই সংকটের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ‘এক-এগারো’–পরবর্তী সময়ে, যখন শেখ হাসিনাকে দল থেকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলেরই কয়েকজন নেতা। পরে অবশ্য দল ওই সংকট কাটিয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনা একটা কথা বলেছিলেন, ‘আমি ফরগিভ করব, ফরগেট করব না।’ তিনি কথা রেখেছেন। ফলে দলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর একক নেতৃত্ব। দলের মধ্যে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা দূরে থাক, সমালোচনা করার সাহসটুকুও কারও নেই। দলের সুস্বাস্থ্যের জন্য এটা ভালো নয়।
১৯৯০-পরবর্তী ২৫ বছরে আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে সরকারে এসেছে এবং তা এখনো অব্যাহত আছে। দেশ এগিয়েছে অনেক। ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ থেকে দেশের এখন উল্লম্ফন ঘটেছে দুনিয়ার ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে। মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ সমমানের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। এই অর্জনগুলোর বেশির ভাগই এসেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে।
টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও সক্ষমতা দুটিই অত্যন্ত জরুরি বিষয়। সত্তর ও আশির দশকে নির্বাচন নিয়ে এ দেশে ছেলেখেলা হয়েছে। ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে মানুষ অবাধে ভোট দেওয়ার অনুকূল বাতাবরণ পেয়েছিলেন। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো ছাড়া সবার কাছেই নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া হোঁচট খেয়েছে বারবার। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা হয়েছে। অর্জনের কৃতিত্ব যেমন অনেকটাই আওয়ামী লীগের, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হওয়ার দায়ও অনেকটাই আওয়ামী লীগের।
তারপরও বলব, আওয়ামী লীগই এ দেশের একমাত্র সংগঠিত রাজনৈতিক দল, যার কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশা অনেক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমতও প্রবল হচ্ছে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে ২০১৩ সালে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে, যেখানে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সব প্রার্থীই পরাজিত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা থেকে অনেকটা ছিটকে পড়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হতে পারে, এমন কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দেশে এখন আর নেই। একসময় বিএনপি ছিল আওয়ামী লীগের বিকল্প। আজ দলটি বিতর্কিত এবং বিপর্যস্ত। আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় বিএনপি আবারও যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য একাধারে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ। কারণ, আওয়ামী লীগ এখন বাধাহীন, বল্গাহীন। অসহিষ্ণুতা আওয়ামী লীগকে গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। অথচ দলটির হওয়া উচিত আরও অনেক বেশি সংবেদনশীল, দায়িত্ববান ও স্বচ্ছ। দলের ভেতর থেকেই আসতে হবে পরিবর্তন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, যারা একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ডুবিয়েছিল, তাদের শাখা-প্রশাখা এখনো ক্ষমতার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। চাটুকার ও বর্ণচোরারা এখন সবাই ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ হয়ে গেছেন। এটা আওয়ামী লীগের জন্য ঘোরতর বিপদ ডেকে আনবে।
এ দেশে একসময় বড় বড় রাজনৈতিক দল ছিল। যেমন: মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ ইত্যাদি। এগুলো আজ ছিন্নভিন্ন। কয়েকটি দলকে তো বিলীয়মান প্রজাতির তালিকায় অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। অথচ প্রবল প্রতাপে টিকে আছে আওয়ামী লীগ। কেননা, শুরু থেকেই এটা ছিল জনগণের দল, গরিব মানুষের দল। আবার এটাও সত্য যে নির্ভরযোগ্য বিকল্প না থাকার কারণে মানুষ অনন্যোপায় হয়ে আওয়ামী লীগকে আরও কিছুকাল সমর্থন দিয়ে যাবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল শুভ হবে না। আওয়ামী লীগকে বদলাতে হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ‘দিনবদলের’ কথা বলেছিল। তখন এটাই ছিল সবচেয়ে সময়োপযোগী স্লোগান। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেকে বদলাতে পেরেছে কি? দলটি সংবেদনশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাছে অনুগত হোক। রাজনৈতিক ভাঁড়দের কবল থেকে দলটি মুক্ত হোক। আওয়ামী লীগের জন্মদিনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।
[email protected]