সিয়াম নৈতিক অবক্ষয় রোধের উপায়

ধর্ম
ধর্ম

সিয়ামের কল্যাণময় শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রোধ তথা চরিত্র সংশোধন। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা, মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি নৈতিক মানবীয় গুণাবলি অর্জনের জন্য ইসলাম মানবজাতিকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। যেহেতু নৈতিকতাবিবর্জিত হয়ে কোনো আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, তাই উন্নত জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য ইসলামি নৈতিকতার প্রয়োজন সর্বাধিক। এ জন্য মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, লেনদেন ও কাজ-কারবারে সিদ্ক ও সততা রক্ষার জন্য জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের সত্য কথা বলা উচিত, কেননা সত্যবাদিতা অবশ্যই পুণ্যের দিকে পরিচালিত করে আর নিশ্চয়ই পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রোজাদারদের জীবনকে যথার্থ সৌন্দর্যময় ও সাফল্যমণ্ডিত করে তার নৈতিক মূল্যবোধ। মানুষের জীবনের সাধনা হচ্ছে মনুষ্যত্ব অর্জনের চেষ্টা। মনুষ্যত্বের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক বিরাজমান। সার্থক মানুষ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ইসলামে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। সিয়াম এমন এক সর্বজনীন ইবাদত, যা রোজাদারকে সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, অন্তরের সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা প্রদান করে। মানুষকে আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর জন্য আল্লাহ তাআলা রোজাকে ফরজ করেছেন।
অনৈতিকতা জঘন্যতম অপরাধ ও সব অপকর্মের মূল। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি সমাজবিরোধী কার্যকলাপের মূলে রয়েছে অসততা আর মানুষের জীবনে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিলে সততার অবসান ঘটে। ফলে সমাজজীবনে নানা রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড, পাপাচার, অনাচার, অবৈধ কাজ প্রভৃতি প্রাধান্য পায়। তখন মানুষের মধ্যে নৈতিক গুণাবলি হারিয়ে যায়। এমনিভাবে মানুষ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে মনুষ্যত্ববোধ লোপ পায়, এতে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সমাজে মানুষের সততা ও নৈতিকতার অভাবে ব্যাপক আকারে অন্যায় ও অনৈতিকতা প্রবেশ করে জাতিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় এবং জাতীয় জীবনে নৈতিক অধঃপতনের সূচনা হয়। রোজাদার ব্যক্তিকে সিয়াম যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে এবং সব ধরনের খারাপ কাজ থেকে বিরত বা সংযত রাখে। ঢাল যেমন শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তেমনি রোজাও শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ। যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা পালন করবে তার এ ঢাল ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। তাই নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ (বুখারি)
সামাজিক জীবনে মানুষ অসৎ হয়ে পড়লে তার ধ্বংস অনিবার্য হয়। সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার বদলে মিথ্যাচারের ফলে আদর্শ পুণ্যবান জীবনের পরিচয় মেলে না। তা ছাড়া, মানুষ যদি একবার নৈতিকতা ও সততা বিসর্জন দিতে পারে তাহলে আর কোনো অবৈধ কাজই তার কাছে অনৈতিক ও সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। এহেন নৈতিকতার অভাব থেকে সকল পাপাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই মানুষের নৈতিক চরিত্র হতে হবে আদর্শবান। সদাচার ও সত্যবাদিতায় সিয়াম সাধনা হচ্ছে ইহকাল ও পরকালে সফলতা ও মুক্তির উপায়। তাই রমজান মাসে রোজাদারদের পরচর্চা, পরনিন্দা ও মিথ্যাচার বর্জনের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন ও অবক্ষয় রোধে রাসুলুল্লাহ (সা.) দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষণা করেছেন, ‘অবশ্যই তোমরা মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকবে, কেননা নিশ্চয়ই মিথ্যা অনৈতিক কাজের দিকে পরিচালিত করে এবং নিশ্চয়ই অনৈতিক কাজসমূহ দোজখের দিকে পরিচালিত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
নিখুঁত ও মর্যাদাপূর্ণ সিয়াম এই যে রোজাদার মিথ্যা কথা বলবে না, ঘুষ খাবে না, জিনিস বাটে কোনো প্রকার দ্রব্য নেওয়ার সময় বেশি মেপে নেবে না এবং দেওয়ার সময় কম মেপে দেবে না। তৈরি খাদ্যে বা চাল, ডাল, তেল ও দুধ জাতীয় তরল খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেবে না ও প্রতারণা করবে না। অনাথ-এতিম বা যেকোনো লোকের সম্পদ অন্যায়ভাবে জোর করে আত্মসাৎ করবে না। হত্যাকাণ্ড, ব্যভিচার, ধর্ষণ ও ছিনতাই করবে না। গিবত বা পরদোষ চর্চা করবে না। অথচ বিপথগামী মানুষ চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, দস্যুবৃত্তি প্রভৃতি নৈতিকতাবিরোধী অনেক অসামাজিক কার্যকলাপ করে থাকে। এতে জনসাধারণের শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় ও সমাজ কলুষিত হয়ে পড়ে। ইসলাম এসব নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং কঠোর শাস্তির বিধান করে দিয়েছে। ইসলাম ব্যভিচার ও শ্লীলতাহানির মতো নৈতিকতাবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। মাহে রমজানে তাকওয়া, সত্যবাদিতা, ধৈর্য, আমানত রক্ষা প্রভৃতি আখলাকে হামিদা বা প্রশংসনীয় আচরণগুলো গ্রহণ করা ইসলামি নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২)
ইসলামের বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, সত্যপথের অনুসারী হওয়া, অন্যের কোনো ক্ষতি না করা, পরোপকারের মহান ব্রতে উদ্দীপ্ত হওয়া—এসবের চর্চা দ্বারাই মাহে রমজানে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে। মানবিক গুণে সমৃদ্ধ চরিত্রই নৈতিক মূল্যবোধে বিকশিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তি জীবনকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে, তার আদর্শ সবার জন্য অনুসরণীয় হয়। সত্যকে সত্য বলে চিনতে পারা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করা রোজাদারের নৈতিক মূল্যবোধের ফল। সৎ, চরিত্রবান, দৃঢ়সংকল্প, আন্তরিক, উদার প্রকৃতির মানুষ নৈতিক মূল্যবোধের সৃষ্টি। আর মূল্যবোধের আদর্শ দিয়ে ন্যায়ের আদর্শকে সমুন্নত রাখা সম্ভব। রোজাদারের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণ যত সুন্দর হবে, ততই সে পুণ্যবান হবে এবং আল্লাহর অধিকতর প্রিয় হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, চারিত্রিক মহত্ত্ব, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক পবিত্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে সিয়াম সাধনা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]