কুপ্রবৃত্তি দমনে রোজার ভূমিকা

ধর্ম
ধর্ম

মানুষের মনে সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি আছে। সুপ্রবৃত্তিগুলো শান্তি, শৃঙ্খলা, ঐক্য, সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা প্রভৃতি সৎ কর্মের প্রতি অনুরাগ এনে দেয়। আর কুপ্রবৃত্তি অনৈক্য, হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচার, নির্মমতা, পাশবিকতা, হত্যাকাণ্ড, ধনসম্পদের লোভ-লালসা, আত্মসাৎপ্রবণতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি অনৈসলামিক ও অমানবিক কার্যকলাপের উদ্ভব ঘটায়। মানুষের কুপ্রবৃত্তির তাড়না থেকে আত্মশুদ্ধির উপায় এবং উন্নততর জীবনাদর্শের অনুসারী হওয়ার জন্যই সিয়ামের বিধান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে অপ্রকাশ্য জিহাদ বলা হয়। এ মর্মে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুজাহিদ ওই ব্যক্তি যে (সব জিহাদের পাশাপাশি) নফসের সঙ্গে জিহাদ করে অর্থাৎ মনচাহি জীবনের বিরোধিতা করে।’
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় বিধায় এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে অপ্রকাশ্য জিহাদ; আরবিতে ‘বাতিনি জিহাদ’ বলা হয়েছে। একদিন নবী করিম (সা.)-কে ‘জিহাদে আকবর’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো: ‘হে আল্লাহর রাসুল! বৃহত্তর জিহাদ কী? তিনি বলেছেন: নফসের সঙ্গে জিহাদ করা।’ (বায়হাকি) রাগের সময় সাধারণত মানুষ নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। তখন মানুষ ক্রোধান্বিত হয়ে সীমা লঙ্ঘন করে, তাই মাহে রমজানে যে ব্যক্তি ক্রোধের সময়ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেই মস্ত বড় জিহাদকারী। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কুস্তিতে যে অন্যকে পরাজিত করে, সে শক্তিশালী নয়, প্রকৃত শক্তিশালী ওই ব্যক্তি, যে ক্রোধের সময় নিজেকে বশে রাখতে পারে।’ অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে ক্রোধের সময় যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, সে-ই আসল শক্তিশালী ব্যক্তি। (বুখারি ও মুসলিম)
রোজাদার মুমিন বান্দা একমাত্র আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কুপ্রবৃত্তি দমন এবং যাবতীয় খারাপ কাজ পরিত্যাগ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের ফলে একজন রোজাদার হালাল খানাপিনা এবং জৈবিক রিপুর তাড়না ও কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হন। তাঁর পক্ষে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী যাবতীয় হারাম কাজকর্ম, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার প্রভৃতি পরিহার করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। প্রতিটি রোজাদারের মধ্যে যখন মানবিক গুণাবলি বিকশিত হবে, প্রতিটি মানুষ যখন হবে প্রকৃত মানুষ; থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি, অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। চূর্ণ হবে মানুষের অহমিকা ও আমিত্ববোধ, সৃষ্টি হবে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি। রোজার মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি আর রোজার ব্যবহারিক উদ্দেশ্য কুপ্রবৃত্তি দমন, আত্মসংশোধন, আত্মসংযম ও খোদাভীতি অর্জন। রোজা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা, সমবেদনা, সহানুভূতি সর্বোপরি খোদাভীতি বা তাকওয়া সৃষ্টি করে।
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভেতর তাকওয়া-খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করতে চান। সেই সত্য-সুন্দরের পথ তাকে সাফল্য ও মুক্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। রমজান মাসের রোজার মাধ্যমে রোজাদার খোদাভীতি অর্জন করেন, সৃষ্টিকর্তার শোকর আদায় করতে শেখেন এবং আল্লাহর হুকুমের কদর বুঝতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সব কাজকর্মের মধ্য দিয়ে রোজাদার মানুষ মূলত আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করেন। একসময় তাতে তিনি সফলকাম হন, তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। এভাবেই রোজাদার বান্দা আল্লাহর সান্নিধ্যে এগিয়ে যান, আর এটাই হলো মাহে রমজানে মানুষের পরম লক্ষ্য। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আহার করে (আল্লাহর) শোকর করে, তার মর্যাদা ধৈর্যশীল রোজাদারের সমপরিমাণ।’ (বুখারি)

>সিয়াম সাধনা মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সাম্য সৃষ্টি করে। রোজাদারদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সহৃদয়তা ও সহানুভূতির ফলে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে

রোজা রাখার কারণে মানুষ নিজেকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। রোজাদার কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে বিভিন্ন যাতনা সহ্য করে খোদাভীতি অর্জনে ব্রতী হন। তাই যদি কোনো রোজাদার ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণাসহ কুপ্রবৃত্তি দমন করে রোজা রাখেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে যাবতীয় কষ্ট সহ্য করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারেন। মাহে রমজানের এ ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষাকেই ধৈর্যের শিক্ষা বলা হয়। রোজার মাধ্যমে কলবকে সুষ্ঠু রাখার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে। এ কলব (অন্তরের) অবস্থাকে পবিত্র ও নির্মল করার জন্য নামাজের পরই রোজার স্থান। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহকে সন্তুষ্ট করানোর আশায় এবং পূর্ণ ইমানদারির সঙ্গে যে রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
সিয়াম সাধনা মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সাম্য সৃষ্টি করে। রোজাদারদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সহৃদয়তা ও সহানুভূতির ফলে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসের রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, সেহ্রি, ইফতার, তারাবি নামাজ, সাদাকাতুল ফিতর, দান-খয়রাত প্রভৃতি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতরাজি, যা রোজাদারদের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। মাহে রমজান বাস্তবিকই যেন মানুষের কুপ্রবৃত্তি বা পশুত্ব, আত্ম-অহমিকা, হিংস্রতাসহ সব অমানবিক দোষ-ত্রুটি ভস্ম করে এবং ধৈর্য-সহনশীলতা, ভালোবাসা-হৃদ্যতা এসব মানবিক গুণাবলি অর্জন করে মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করার জন্য রোজাদারদের সচেষ্ট হতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]