মারধরে বিনষ্ট হয় শিশুর ভবিষ্যৎ

কিছুদিন আগে আরাফাত শাওন নামের ১৫-১৬ বছরের এক বালক আত্মহত্যা করে। যত দূর মনে করতে পারি এসএসসি পরীক্ষায় তার জিপিএ ছিল ৪.৮৩। তার বিদ্যালয় থেকে যারা এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল, শাওন ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। তিন মাস ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ওই ফলাফলেই সে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু তার বাবা-মায়ের প্রত্যাশা ছিল জিপিএ–৫। বাবা-মায়ের বকাঝকা ও পারিবারিক অসন্তোষের মুখে শাওন আত্মহত্যা করে বসে। শাওনের আত্মহত্যা তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ঘটনাটি আবার মনে পড়ে গেল ৬ জুলাই প্রথম আলোর প্রথম পাতার প্রধান প্রতিবেদনটি দেখে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল: ‘দুই-তৃতীয়াংশ শিশুকে মারধর করেন মা-বাবা’। অর্থাৎ পড়াশোনার স্বার্থে এবং শৃঙ্খলা ও আদবকায়দা শেখাতে গিয়ে বাবা ও মায়েরা শিশুদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন।
ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ৫৯ হাজার ৮৯৫টি পরিবারের ওপর একটি জরিপ করেছে এবং এতে ৭৫ হাজার ৯০৭ জন শিশুর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ওই জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয় তিন-চার বছরের শিশুদের—৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ। চিন্তা করা যায়, তিন-চার বছরের শিশুদের পেটাচ্ছেন তাদেরই
মা ও বাবারা! তিন অথবা চার বছর বয়স, যখন একটি শিশু আধো আধো বোলে কথা বলতে শুরু করেছে, যখন সে সবে হাঁটতে ও ছুটতে শুরু করেছে, যখন এইটুকুন এক শিশু তার বোধ, দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ ও স্বাদ দিয়ে চারপাশের অবাক পৃথিবীকে আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছে, তখনই তার বাবা-মা তাকে চড়-থাপড় মারছেন, অথবা পিঠে কিল-ঘুষি দিচ্ছেন!
আমরা শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি করেছি, সামাজিক উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলোতে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছি, সম্প্রতি মধ্যম আয়ের দেশের প্রাথমিক স্তরে উন্নীত হয়েছি, কিন্তু এখনো আমাদের সমাজ যথেষ্ট পরিমাণে সভ্য নয়। ওই অর্থে যে এখনো আমরা নারীদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। আরও যেসব ক্ষেত্রে এ সমাজের গুরুতর গলদ আছে, তার একটি হচ্ছে, শিশুদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। কেমন পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠবে, শিশুদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হবে—এসব বিষয়ে এ সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো মানবিক নয়। জরিপের ফলাফল থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, প্রতি তিনজন মায়ের মধ্যে একজন বিশ্বাস করেন, নিয়মকানুন শেখাতে সন্তানদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে মায়েদের চেয়ে বাবারা আরও বেশি ‘নিষ্ঠাবান’! সমাজের পুরুষ সদস্যরা—বাবা, মামা, চাচা, ও শিক্ষকেরা শিশুদের আদবকায়দার পাঠ দিতে ও শৃঙ্খলা শেখাতে ‘প্রহারকেই শ্রেষ্ঠ ওষুধ’ বলে মনে করেন!
বাংলাদেশের মা-বাবারা কি জানেন, শিশুকে মারধর করা ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৭০ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ? যে শিশু আপনার তত্ত্বাবধানে বা হেফাজতে রয়েছে, অথবা যে শিশুর আপনি দেখভাল করছেন, তাকে মারধর করা, তাকে কষ্ট দেওয়া বা তাকে মানসিক নির্যাতন করার কোনো অধিকার আপনার নেই, এমনকি আপনি তার বাবা-মা হলেও। এ জন্য দায়ী ব্যক্তির পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এ তো গেল আইন ও দণ্ডের দিক। বকাঝকা, গালমন্দ ও মারধর শিশুর মানসিক বিকাশ, শেখার সক্ষমতা, ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিপক্বতার জন্যও ভালো নয়। জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শারীরিক শাস্তি শিশুর উন্নয়ন, শেখার ক্ষমতা ও বিদ্যালয়ের পারদর্শিতা বাধাগ্রস্ত করে। নানা রকম সমীক্ষা ও গবেষণা দ্বারা এটা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত যে শিশুদের গালমন্দ বা মারধর করা অথবা তাদের ওপর কোনো জোর-জবরদস্তির পরিণতি হয় নেতিবাচক ও ভবিষ্যদ্বিনাশী। ফলে সভ্য সব দেশেই আইন করে শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করা হয়েছে। সারাক্ষণ বকাঝকা করলে শিশুর মধ্যে পর্যাপ্ত আস্থার অভাব দেখা দেয়, গালমন্দ করলে মনের ওপর চাপ পড়ে, আর মারধর করলে শিশুর সংবেদনশীলতা নষ্ট হয় অথবা শিশু হয়ে পড়ে মারাত্মক রকম একগুঁয়ে। জগদ্বিখ্যাত মনঃসমীক্ষক সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, জন্মের পর প্রথম পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের গঠন সম্পন্ন হয়ে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শিশুদের মারধর বা নির্যাতন না করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে গিয়ে আনন্দের সঙ্গে শিশুদের পাঠদানের কথা বলেছেন।
আরাফাত শাওনের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। সে তার ‘সুইসাইডাল নোট’-এ লিখেছে, ‘আমি আদৌ জানি না যে আমি কে? এই পরিবারের বা আমার মা-বাবার সন্তান? তা না হলে এ রকম...কড়া শাসনের ওপর আমাকে রাখা হয়েছে...এভাবেই প্রতিনিয়ত আমাকে বকাঝকা করা হয়।’ রেজওয়ানুল নাফিস, যিনি কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দিতে গিয়ে ধরা পড়ে মার্কিন আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি বিচারকের অনুকম্পা চেয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন, ওই চিঠিতে তিনি ছোটবেলা তার বাবা-মায়ের পর্যাপ্ত মনোযোগ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক টেড বান্ডির শৈশব ছিল ভয়াবহ। প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার, গালমন্দ, মায়ের মমতা না পাওয়া ইত্যাদি কারণে টেড বান্ডির মধ্যে মানসিক বিকৃতি ও আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। একসময় টেড বান্ডি হয়ে ওঠে এক ভয়াবহ সিরিয়াল কিলার। যদিও টেড বান্ডি ২৭ জন নারী ও বালিকাকে খুন করার কথা কবুল করেছেন, কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করেন, তিনি শতাধিক নারী হত্যার সঙ্গে জড়িত।
এযাবৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশুদের ওপর যেসব গবেষণা ও সমীক্ষা হয়েছে, তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, শিশুদের গালমন্দ বা মারধর করা তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য শুভ ও ইতিবাচক নয়। এ ছাড়া ভয়াবহ অপরাধী ও অনেক সিরিয়াল কিলারের জীবনবৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখা গেছে যে তাদের শৈশব ছিল ত্রুটিপূর্ণ। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশের মা-বাবা, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা শিশুদের গালমন্দ ও মারধর করার পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষ্ঠুর অভ্যাস থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসবেন। ওতেই শিশুদের কল্যাণ নিশ্চিত হবে, ভবিষ্যতের সমাজ হয়ে উঠবে সুস্থ ও সভ্য।
শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক, মানবাধিকার ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক।