ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির ফল কী হবে?

রিচার্ড এন হাস
রিচার্ড এন হাস

ওয়াশিংটন ডিসিতে এবং বোধগম্য কারণে তেহরানে ৬০ দিনের তুমুল তর্কবিতর্কের পর ১৪ জুলাই ইরান ও জার্মানিসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মধ্যে যে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ স্বাক্ষরিত হলো তা সম্ভবত কার্যকর হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এর মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটবে, অথবা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান গোলযোগে ইরানের যে ভূমিকা রয়েছে, তা শেষ হবে। বরং উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে: চুক্তিটি কীভাবে বাস্তবায়িত ও কার্যকর হবে, তার ওপর নির্ভর করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
তবে আমি এটাও বলতে চাচ্ছি না যে এই চুক্তির কোনো ইতিবাচক অবদান থাকবে না। ইরান আগামী এক দশকে কী পরিমাণে ও কোন মানের সেন্ট্রিফিউজ রাখতে পারবে, তার সীমা এই চুক্তিতে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই চুক্তির বলে ইরান আগামী ১৫ বছর খুবই অল্প পরিমাণে নিম্ন-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রাখতে পারবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায় এই চুক্তিতে এটাও আছে যে ‘যখন ও যেখানে প্রয়োজনের’ ভিত্তিতে একটি অনুসন্ধান দল কাজ করবে, যারা খতিয়ে দেখবে, ইরান এই অঙ্গীকারসহ অন্যান্য অঙ্গীকার পূরণ করছে কি না।
এই চুক্তির মোদ্দা ফলাফল হচ্ছে এর ফলে ইরানের এক বা একাধিক পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগবে। আগে কয়েক মাস লাগার কথা থাকলে এখন লাগবে এক বছর। এই চুক্তির কারণে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে ইরান তেমন চেষ্টা করলে সেই খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। চুক্তিটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর ফলে ইরানকে আগামী ১৫ বছর পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া থাকতে হবে। শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এটা অর্জন করা সম্ভব হতো না। এমনকি সামরিক বল প্রয়োগ করলেও নানা ঝুঁকির সৃষ্টি হতো, আর ফলাফল হতো অনিশ্চিত।
অন্যদিকে, (কূটনীতিতে সব সময়ই একটা অন্য দিক থাকে) এই চুক্তির কারণে ইরান তার প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে, যদি সে শুধু বেসামরিক গবেষণায় তা কাজে লাগাতে চায়, আর সে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে তার প্রতীকী সক্ষমতা দেখায়। এই চুক্তির কারণে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞার খড়্গ উঠে যাবে, এতে তার মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি যুদ্ধ চালানো, ইরাকের উপদলীয় সরকারকে সমর্থন ও সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে সমর্থনের সক্ষমতা বাড়বে।
উপরন্তু এই চুক্তিতে এমন কিছু নেই, যার কারণে ইরানের সব ধরনের পরমাণু-সম্পর্কিত গবেষণা বন্ধ বা ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর কাজ ব্যাহত হবে। ইরানের কাছে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রপাতি বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে আট বছরের জন্য, আর প্রথাগত অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য, তার বেশি নয়।
আবার এমন বিপদও আছে যে ইরান চুক্তির শর্তের অংশবিশেষ পালন করতে পারবে না এবং নিষিদ্ধ কাজ হাতে নেবে। ইরানের অতীত কর্মকাণ্ডের যে ইতিহাস, তা থেকে এটাই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয়, চুক্তিটির সমালোচনার জায়গাও এটি। ইরান চুক্তির শর্ত না মানলে তার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে, এমনকি প্রয়োজনে সামরিক বলও প্রয়োগ করতে হবে।
আরও বড় একটা সমস্যার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশ কম। সমস্যাটা হলো ইরান যদি চুক্তির শর্তাবলি মেনে চলে, তাহলে কী হবে। চুক্তির শর্তাবলি ভঙ্গ না করলেও তো একটা সময়ে সেগুলোর মেয়াদ শেষ হবে, তারপর সে তার পারমাণবিক সীমাবদ্ধতা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারে। তখন একমাত্র পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) ছাড়া ইরানের রাশ টেনে ধরার উপযোগী কিছু থাকবে না। কিন্তু এনপিটি একটা স্বেচ্ছাভিত্তিক চুক্তি, এই চুক্তি ভঙ্গের জন্য শাস্তির বিধান নেই।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে যুক্তরাষ্ট্র (তার সঙ্গে অন্যরাও যোগ দিলে ভালো হয়) ইরানকে এ বিষয়টি জানিয়ে দিক, ১৫ বছর পর ইরান আবার পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করলে সেটা সহ্য করা হবে না। এই চুক্তিতে এটা পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি। এই চুক্তির পর ইরান সে রকম চেষ্টা করা মাত্র তার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। এটাও এ চুক্তিতে বলা হয়নি।
ইরান যদি পৃথিবীকে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে যে সে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে, এটা নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ নেই, তাহলে তাকে জানিয়ে দিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা প্রতিরোধমূলক সামরিক আক্রমণ চালাবে। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দিয়ে পৃথিবী বড় ভুল করেছে, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর করতে দেওয়া চলবে না।
এর মধ্যে ইরানের প্রতিবেশীদের উদ্বেগ প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশটির অনেক প্রতিবেশীই বাজি ধরবে, ইরান ১৫ বছর পর নিজেরাই পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। মধ্যপ্রাচ্য তো এখনই দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে, সম্ভাব্য পারমাণবিক শক্তিগুলোর উত্থান ছাড়াই। ওবামা যে দাবি করেছেন, এই চুক্তি ‘সে অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করেছে’ সেটা তিনি একটু আগেভাগেই করে ফেলেছেন। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার কৌশলগত আস্থা নতুন করে গড়তে হবে, ওবামার উত্তরসূরির জন্য সেটা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এর কোনো কিছুর মানে এই নয় যে ইরানকে সীমিত পরিসরে সহযোগিতা করা যাবে না, তা সে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক যেখানেই হোক না কেন, যদি আমাদের স্বার্থ এক হয়। কিন্তু এখানেও বাস্তবতাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কেউ যেন তুলনা করার জন্য এটা না ভাবে যে এই চুক্তি ইরানের উগ্রতায় জল ঢেলে দিয়ে তার কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাশ টেনে ধরবে। বস্তুত আগামী দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে অধিকতর সক্ষম ইরানের আবির্ভাব, যদি তা সারা বিশ্বের জন্য না-ও হয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
রিচার্ড এন হাস: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের প্রেসিডেন্ট।