সময়ের চাকা উল্টো দিকে ঘোরানো নয়

তথ্য হচ্ছে উন্নত বিশ্বের একটি অপরিহার্য সম্পদ। তথ্য ব্যতিরেকে, না সরকার না নাগরিক, কেউই যথাযথভাবে দায়িত্ব নির্বাহ করতে পারে না। তথ্যের পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করে দেশের সফলতা ও ব্যর্থতা। প্রচলিতভাবে নথি এবং আর্কাইভস হচ্ছে তথ্যের মূল উৎস। নথি ও আর্কাইভস সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণে সহায়তা করে। একইভাবে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্যও এর প্রয়োজন হয়। আর্কাইভস প্রশাসন ও নথি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বিভিন্ন নামে এক বা একাধিক আর্কাইভস আইন প্রণীত হয়েছে। যেমন: ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডে পাবলিক রেকর্ডস অ্যাক্ট, সাউথ কোরিয়ায় পাবলিক রেকর্ডস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, জাপানে পাবলিক রেকর্ডস অ্যান্ড আর্কাইভস ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ওমানে রেকর্ডস অ্যান্ড আর্কাইভস ল এবং অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যাক্ট নামে এই আইন প্রচলিত আছে। আইনের নামকরণ যাই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞদের মতে আইনের উদ্দেশ্য হতে হবে:
সুষ্ঠু নথি ব্যবস্থাপনার সাহায্যে সব সরকারি কার্যালয়কে সরকারের কাছে দায়বদ্ধ করা, একই সঙ্গে সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করা,
সরকারি নথির প্রতি জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করা, দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করা, জাতীয় আর্কাইভসকে দেশের নথি ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে নির্ধারণ করে একে উপযুক্ত দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রদান করা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার আর্কাইভস প্রশাসন ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই আইনের একটি ‘চূড়ান্ত খসড়া’ আমাদের নজরে এসেছে। খসড়ায় লক্ষ করেছি যে আইনটি এককভাবে জাতীয় আর্কাইভস প্রশাসন ও দেশের নথি ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট হচ্ছে না। একই অধিদপ্তরের আওতাধীন হওয়ায় এর সঙ্গে জাতীয় গ্রন্থাগারকেও সংযুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্কাইভস প্রশাসন ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সর্বোচ্চ সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভসের (আইসিএ) নির্দেশাবলিতে উল্লেখ আছে, ‘নথি ও আর্কাইভস সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি দেশ এক বা একাধিক আইন প্রণয়ন করতে পারে তবে আইনের ধারা হতে হবে স্বচ্ছ ও সংগতিপূর্ণ।’ আমরা একই আইনে আর্কাইভস প্রশাসন, নথি ব্যবস্থাপনা ও গ্রন্থাগার প্রশাসনকে যুক্ত করলে তা যৌক্তিক হবে না বরং সময়ের চাকাকে উল্টো দিকে ঘোরানোর নজির সৃষ্টি হবে।
খসড়া আইনের আর্কাইভস অংশটি পর্যালোচনা করলে মনে হয় যে এটি তৈরিতে যে পরিমাণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল তা করা হয়নি। এও মনে হয়নি যে এটির প্রস্তুতিতে আন্তর্জাতিক নির্দেশাবলি বা মান অনুসরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শঙ্কা হয় যে আইনটি বর্তমান অবস্থায় গৃহীত হলে আমাদের প্রত্যাশা পূরণে সফল নাও হতে পারে।
খসড়া আইনটিতে মূলত জাতীয় আর্কাইভসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে সারা দেশের নথি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশেষ কিছু উল্লেখ নেই। লাটভিয়ার আর্কাইভস আইনে নথি সৃষ্টিকারী সংস্থার জন্য প্রযোজ্য বাধ্যবাধকতার লম্বা তালিকা দেওয়া আছে। ভারতীয় আর্কাইভস আইনে প্রতিটি নথি সৃষ্টিকারী সংস্থায় একজন করে রেকর্ডস অফিসার নিয়োগ বাধ্যতামূলক। আইনে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত আছে। এই অফিসার সংস্থার নথি সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য জাতীয় আর্কাইভসের প্রধানের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। জাতীয় আর্কাইভস নথি সৃষ্টিকারী সংস্থা ও রেকর্ডস অফিসারদের নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সারা দেশের আর্কাইভস ও নথি ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব দিতে পারে। আইসিএর নির্দেশিকায় উল্লেখ আছে, ‘সারা দেশের নথি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি ও নেটওয়ার্কের উন্নয়ন সহজতর করার জন্য জাতীয় আর্কাইভসকে সরকারের ভেতর ও বাইরের আর্কাইভস সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে নেতৃত্বে দিতে হবে।’
সাধারণভাবে এই আইন সরকারি, আধা সরকারি ও সরকারি অর্থে পরিচালিত সংস্থাসমূহের জন্য প্রযোজ্য হয়। তবে বেসরকারি ও সামাজিক সংস্থার ক্ষেত্রে এই আইনের কতটুকু প্রযোজ্য হবে তারও উল্লেখ থাকে। আইসিএর নির্দেশিকায় উল্লেখ আছে, ‘আর্কাইভস আইনের পরিধি অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে। সরকারি সংস্থা ছাড়াও জনসম্পৃক্ততা আছে এমন সব সংস্থাকে এই আইনের আওতায় আনার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।’ আমাদের দেশে তথ্য অধিকার আইন প্রচলিত আছে। সরকারি কার্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাসমূহে উন্নত নথি ব্যবস্থাপনা না থাকলে জনগণের তথ্য অধিকার কার্যত ব্যর্থ হবে। তাই আর্কাইভস আইনে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আইনে দেশের আর্কাইভস প্রশাসন ও নথি ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কে হবে এবং তার দায়িত্ব, কর্তব্য, ক্ষমতা ইত্যাদি কেমন হবে, তা উল্লেখ থাকে। বেশির ভাগ দেশেই জাতীয় আর্কাইভস নথি ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে নির্ধারিত হয়। তবে কোনো কোনো দেশে এ বিষয়ে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে।
জাতীয় আর্কাইভস, দেশের নথি ব্যবস্থাপনা ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর উন্নয়নের জন্য আর্কাইভস আইনে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিধান আছে। ইউনেসকোর নির্দেশাবলিতে উল্লেখ আছে, ‘নথির উৎসের অনন্য চরিত্র এবং বৈচিত্র্যের কারণে [আর্কাইভস প্রশাসন ও নথি ব্যবস্থাপনায়] একটি সংগঠন থাকা জরুরি, যার পরামর্শ প্রদান, সমন্বয় সাধন, তত্ত্বাবধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকবে। প্রয়োজনে এটি আর্কাইভসসমূহে ব্যবহারোপযোগী কর্মপদ্ধতির সাধারণ মানদণ্ড সূত্রবদ্ধ করতে সক্ষম হবে। এর আইনগত পরিধি জাতীয় আর্কাইভসের সংগঠন, কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করে এমন সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে।’ প্রণিতব্য আইনে এ ধরনের উপযুক্ত উপদেষ্টা পরিষদ এবং তাকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধান থাকতে হবে। আইসিএ এবং ইন্টারন্যাশনাল রেকর্ড ম্যানেজমেন্ট ট্রাস্ট (আইআরএমটি)-এর নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে আদর্শিকভাবে পরিষদের সদস্যসংখ্যা কম হবে এবং তাদের যোগ্যতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হবে।
এই আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিনীতভাবে অনুরোধ করব যে আপনাদের প্রচেষ্টাটি যাতে সর্বাত্মকভাবে সফল হয়, এ জন্য আপনারা এ বিষয়ে ইউনেসকো, আইসিএ, আইআরএমটি এবং অন্যান্য উন্নত দেশের নির্দেশাবলিগুলো অনুসরণ করুন। ভারতের আর্কাইভস আইন প্রণয়নের জন্য গঠিত পরিষদের কর্মকাণ্ড আপনাদের সাহায্যে আসতে পারে বিবেচনায় নিচে সংক্ষিপ্ত একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করলাম। তাদের কার্যকালে তারা ১২টি স্টেট ভ্রমণ করেছিল, এর জন্য তাদের ১০ হাজার মাইল পথ পরিক্রম করতে হয়। তারা প্রতি স্টেটে সংশ্লিষ্ট ১০-১২ জন করে মোট ১৩৬ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। তারা ১১টি মন্ত্রণালয় এবং এদের অধীন ২৫৩টি সংস্থা পরিদর্শন করে। দেশের আর্কাইভস প্রশাসন ও নথি ব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র পাওয়ার জন্য ৭৫টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নমালা প্রচার করে। পরিষদ ১৭ বার সভায় মিলিত হয় এবং শেষে ১২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
নথি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের জরিপে উল্লেখ আছে, ‘বাংলাদেশে নথি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বের দিক থেকে খুব নিম্নে। এতে সরকারের কর্ম সম্পাদন ও সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে এবং টেকসই আইসিটি পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা থাকছে।’ পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক আর্কাইভস আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করছে নথি ব্যবস্থাপনার দৈন্যদশা থেকে উত্তরণের পথ।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।
[email protected]