অস্থির সমাজ ও আমাদের ক্রিকেট

ক্রিকেটের অভূতপূর্ব বিজয়ে উল্লসিত দর্শক
ক্রিকেটের অভূতপূর্ব বিজয়ে উল্লসিত দর্শক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক অনেক পণ্ডিত সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। অনেক ধরনের মন্তব্যও করেছিলেন, যা ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। সেখান থেকে বিগত পঁয়তাল্লিশ বছরে বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে কতখানি অগ্রগামী হয়েছে, তার খতিয়ানও এখন সর্বজনবিদিত। তবে কিছু কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি তেমন হয়নি। তবু যতটুকু উন্নতি হয়েছে, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে বাংলাদেশের আপামর জনগণের, খেটে খাওয়া মানুষের আর আমাদের দেশের শিল্পপতিদের।
দেশের যতটুকু শিল্পায়ন হয়েছে, তার পেছনেও খেটে খাওয়া মানুষের আর দেশি শিল্পপতিদের অবদান সবচেয়ে বেশি। যদিও আমরা অর্থনৈতিক হিসাবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি; তথাপি অন্তত আমার মতে, এ হিসেবে শুভংকরের ফাঁকিও রয়েছে। কারণ, আমাদের উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের মধ্যে কতখানি তফাত রয়েছে, তার একটি ছোট উদাহরণ হিসেবে ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় বিতরণ নিয়ে এত মৃত্যুর উল্লেখ করা যেতে পারে।
দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে, তার পেছনে অতীত ও বর্তমান সরকারগুলোর যে সহযোগিতা নেই, তেমন বলা যাবে না। তবে আমরা সব সময়ই আরও চাই। বাংলাদেশের অন্যান্য সামাজিক ক্ষেত্রেও এ ধরনের উন্নয়নের কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি, কারণ অতি সহজ; উপর্যুপরি সরকারগুলো সুশাসন দিতে পারেনি, যার কারণে ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একধরনের অস্থিরতা দৃশ্যমান। ভাবতে অবাক লাগে যে একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে সরকার উন্নতির খাতিরে কম গণতন্ত্রের পুরোনো থিওরি নতুন করে মনে করাচ্ছে, সেখানে সামাজিক উন্নতির ধারেকাছে নেই।
সিলেটে রাজন হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে হত্যাকারীদের দেশ ছাড়ার ঘটনা প্রমাণ করে বিগত বছরগুলোতে সমাজের কতখানি অবক্ষয় হয়েছে। এর সঙ্গেও পুলিশের কিছু সদস্যের ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয় পত্রপত্রিকায় শিরোনাম এসেছে। সর্বক্ষেত্রে প্রশাসনের দলীয়করণ এবং একধরনের বিচারহীনতা সমাজকে ঘুণে ধরার মতো ভেতর থেকে ফাঁকা করে দিচ্ছে।
সিলেটের রাজন হত্যা একটিমাত্র ঘটনা নয়, তবে বহু আলোচিত এবং সচেতন মানুষের সোচ্চার হওয়ার কারণে আমরা অনেকের দৌড়ঝাঁপ দেখছি, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা এরপরও ঘটেছে। এখনো ঘটে চলেছে। নারায়ণগঞ্জে কবুতর চুরির অভিযোগে দুই বালককে যেভাবে নির্যাতন করা হয়, তা ছিল অমানুষিক। পত্রিকায় ওই ঘটনা পড়ার পর মনে হয়েছিল, আমাদের বাল্যকালের সমাজে এ ধরনের অস্থিরতা থাকলে আম ‘চুরি’ অথবা পেয়ারাগাছ থেকে পেয়ারা ‘চুরি’র অভিযোগে আমাদের প্রজন্মের অর্ধেককেই নিদেনপক্ষে বিকলাঙ্গ হয়ে থাকতে হতো; যদি ওই সময়ে সমাজে এ ধরনের অস্থিরতা থাকত। এ ধরনের ঘটনা ‘বাল্যকালের’ স্মৃতি হিসেবে আমাদের সাহিত্যকেও বহুভাবে সমৃদ্ধ করতে পারত না। ওই সময়কার সমাজ এত অস্থির থাকলে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কলম থেকে ‘লিচু-চোর’-এর মতো কবিতা বের হতো না। ওই কবিতার এক লাইন ‘প’ড়বি পড় মালীর ঘাড়েই’ আজও উপমা হয়ে রয়েছে।
ওপরে বর্ণিত সমাজের অস্থিরতার প্রমাণ দেয়, এমন আরও বহু ঘটনা প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে। সমাজে সহিষ্ণুতা কমে গেছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রশাসনে অস্থিরতা, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ এখন আর আশ্চর্য হওয়ার বিষয় নয়। সমাজের এ ধরনের অস্থিরতার কারণ খুঁজতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা সুশাসনের অভাবকেই দায়ী করছেন। হয়তো অনেকেই বলবেন, সুশাসনের সংজ্ঞা কী? হয়তো এ ধরনের মতামতের পেছনে অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজতে থাকবেন। তবে আমাদের দেশে অতীতে এবং এখন যে ধরনের শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান, তা সুশাসনের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। সুশাসনের বিষয়টি বেশ বিস্তারিত, এত ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। হয়তো অন্য আরেক সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি।
বাংলাদেশের অনেক প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মাঝে আমার কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের হালের উত্থানকে অনেক বড় অর্জন মনে হয়। হয়তো বা ওই খেলাটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। ছোটবেলা থেকেই এই খেলাটি যেমন উপভোগ করেছি, তেমনি ধৈর্য ধরে যখনই সুযোগ পেয়েছি দেখেছি অথবা রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনেছি। আমাদের সমসাময়িক প্রজন্মের সামনে ওই সময়ে আজকের মতো টেলিভিশনের পর্দা ছিল না। রেডিও ছিল একমাত্র ভরসা। ওমর কোরেশি ও জামশেদ মার্কারের ধারাভাষ্য ইংরেজিতে হলেও সহজবোধ্য ছিল। ওই সময়ে পাকিস্তানের দলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ খেলায় ইস্ট পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের অবস্থান একেবারে খারাপ ছিল না। তথাপি বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে তৎকালীন ক্রিকেটারদের। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ফুটবলের প্রাধান্য। অনেক বাঙালি ফুটবলার পাকিস্তানের দলে খেলে আন্তর্জাতিক পরিচিতিও পেয়েছিলেন। অবশ্য স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে দু-তিনজন ক্রিকেট প্লেয়ার পাকিস্তানের দলের তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য দু-একজন মাঠেও নেমেছিলেন।
তৎকালীন পাকিস্তানের বনেদি ক্রিকেট ঘরানার কর্তাব্যক্তিদের মতে, বাঙালিরা ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত ছিল না, যে মতামত হতে বহু পাকিস্তানি বনেদি ক্রিকেটার সরে আসতে পারেনি। রমিজ রাজা আর সরফরাজ নওয়াজরা এদের প্রতিনিধিত্ব করে, যেমন করে ভারতের নভোজিৎ সিং সিধু। এককালের বাঙালিদের কাছে যে খেলা ছিল প্রায় অধরা, আজ বাঙালি ক্রিকেট দলের তরুণেরা এসব বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিচ্ছে। এটাও আমাদের স্বাধীনতার বড় অবদান, যা প্রতিফলিত হয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজার বক্তব্যে।
শুরুতে বাংলাদেশের ক্রিকেট সীমাবদ্ধ ছিল শহুরে খেলা হিসেবে। সেখান থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ বহু দূরে এসেছে। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আওয়ামী লীগপ্রধান, আজকের প্রধানমন্ত্রী বরাবরই ক্রিকেট অনুরাগী এবং তাঁরই সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট ধাপে ধাপে উৎকর্ষিত হয়েছে। অবশ্য সব সরকারই ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। কাজেই রাজনৈতিকভাবে অতি বিভাজিত জাতি এই এক জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হয়। হবেই না বা কেন, একমাত্র ক্রিকেটই বিশ্বের বিভিন্ন চ্যানেলে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে সম্প্রচারিত হয়। এরই সুবাদে শুধু দেশই নয়, বাংলাদেশের বহু ক্রিকেটার এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উঁচু স্তরে উঠেছেন। সাকিব আল হাসান তো আছেনই, হালে চর্চিত হচ্ছে বেশ কয়েকজনের নাম, যার মধ্যে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় ১৯ বছরের আশ্চর্যবালক মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার ও লিটন দাসদের মতো তরুণ ক্রিকেটারদের।
মুস্তাফিজুর যে বিশ্বের বিস্ময়বালক হয়েছে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ছোট শহর, ততোধিক ছোট অপরিচিত গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে যেভাবে মুস্তাফিজুর উঠে এসেছে, তা রূপকথার মতোই। তেমনি সৌম্য সরকার এবং এমনই অনেকে। এরা সমাজের শক্ত বিভাজন ছিঁড়ে সাহসের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। পথ দেখিয়েছে, আমরা যাদের প্রান্তিক অঞ্চলের প্রান্তিক যুবক মনে করি, তাদের। এরা শত বছরের ওপরে বনেদি ক্রিকেট টিম এবং উচ্চবিত্তদের দেখিয়েছে যে সামর্থ্য এবং অধ্যবসায় থাকলে যে কারও পক্ষে আকাশ স্পর্শ করা সম্ভব।
যদিও আমি আমাদের অগণিত প্রান্তিক অঞ্চলের যুবকদের কথা বলেছি তার মানে এই নয় যে শুধু সামর্থ্যই যথেষ্ট। তেমনটি হয়তো এখনো সত্য নয়। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এদের সামনে নিয়ে আসা সম্ভব হতো না। এখানেই বর্তমান ক্রিকেট বোর্ডের সাফল্য। আগের বোর্ড যে বীজ বপন করেছিল তাকে আরও এগিয়ে নিয়েছেন বর্তমান বোর্ড এবং বোর্ডের সভাপতি। নাজমুল হাসান এমপিকে এই জাতির অভিনন্দন জানানো উচিত এ কারণে যে দেশের বৃহত্তর আঙ্গিকে সুশাসনের অভাব থাকলেও দৃশ্যত তাঁর নেতৃত্বে ক্রিকেট বোর্ডে সুশাসন এবং নিরপেক্ষতা রয়েছে। ক্রিকেট বোর্ড অন্তত দলীয়করণের এবং রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকতে পারাতে অচেনা-অজানা গাঁয়ের তরুণদের এত বড় পরিসরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। অন্তত এখানে রাজনীতির অথবা দলীয় প্রভাবের গন্ধ নেই। এ কারণেই বর্তমান বোর্ড আমাদের ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে।
আমার এ লেখার সমাপ্তি টানার আগে বর্তমান ক্রিকেট বোর্ডের কাছে আবেদন করব, আমাদের টিমের একেবারে তরুণ সদস্যদের আজকের বাণিজ্যিক ক্রিকেট হতে কিছু সময়ের জন্য দূরে রাখবেন। এরা এখনো তরুণ, অপরিণত বয়সের সমাজ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রীতিনীতি সম্পর্কে এখনো পরিপক্ব নয়। ক্রিকেট এখন অনেক জায়গায় যেভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাকচিক্য আর গ্ল্যামার জগৎ, যেসবের ভিড়ে অনেক তরুণের হারিয়ে যাওয়ার কথা। আমরা আশরাফুলের মতো ক্রিকেটারকে হারিয়েছি। আমরা এখনই আমাদের দেশের এসব উঠতি তরুণ খেলোয়াড়কে হারাতে চাই না। চাই না অহেতুক বিদেশের মাটিতে বাণিজ্যিক ক্রিকেটের চাকচিক্য আর গ্ল্যামারের জগতে হারিয়ে যাক। মুস্তাফিজের মুখের সরল হাসি আর আনন্দের আতিশয্যের হাতের তালি অসময়ে হারিয়ে যাক।
এখনকার সময়ের এসব নতুন প্লেয়ার যারা বিস্ময় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের ব্যক্তিগত ও নৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও বোর্ডের। এরা জাতীয় সম্পদ। আমাদের জাতীয় জীবনে উন্নতিও যেমন আছে, তেমনি হতাশাও রয়েছে। আমরা প্রতিদিন আশার আলো দেখি। ক্রিকেট আমাদের আশার আলো দেখায়। আমরা কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক চাকচিক্য এবং কুচক্রের কাছে আশার আলো বিসর্জন দিতে চাই না।
আমি আশা করি, আমাদের দেশের বর্তমান অতি কর্মতৎপর ক্রিকেট বোর্ড আমার মতামত অন্তত ভেবে দেখবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য ক্রিকেট বোর্ডকে অশেষ ধন্যবাদ।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
[email protected]