রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ও বাংলাদেশ

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

প্রজাতন্ত্রে রাজ্য পরিচালনার মূলমন্ত্র ‘প্রজাদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও অবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করা।’ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকের কর্তব্য এ লক্ষ্য সামনে রেখে তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এক কথায় প্রশাসকের কাজ প্রজার মঙ্গল করে তাঁকে খুশি করা। প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীর প্রয়োজন হয় প্রজাতন্ত্রে। তাদের কাজ হয় দেশের সব সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, ব্যবহারের উপযোগী রক্ষণাবেক্ষণ করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ইত্যাদি। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক প্রজাদের কল্যাণ সামনে রেখে ওই কাজগুলো পরিচালিত হচ্ছে সে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। প্রশাসন ও বাহিনীসমূহ শুধু জনকল্যাণে ব্যবহৃত হবে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে বা জনগণের বিপক্ষে নয়, এটা বাধ্যবাধকতা। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেগুলো অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

প্রজাতন্ত্রে কোনো প্রশাসক যখন ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চান, প্রজাদের উন্নয়ন ও স্বার্থ সংরক্ষণের চেয়ে নিজের স্বার্থের দিকে
বেশি ঝুঁকে পড়েন, তখন তাঁকে জবাবদিহির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। প্রজাদের কাছে প্রশাসক বা সরকারের জবাবদিহির জন্য সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে দুর্বল ও অকার্যকর করতে হয়। সেটা সম্ভব হয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে জবাবদিহির জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে। যেমন সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজকার্যের প্রধান নির্বাহী বা সরকার এবং সার্বিকভাবে নির্বাহী বিভাগের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে সংসদের ওপর। এ বিষয়ে সাহায্যকারী পরবর্তী প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ। আবার নির্বাহী, সংসদ ও বিচার বিভাগ পরস্পরের ওপর নজরদারির মাধ্যমে জবাবদিহির সার্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিভিন্নভাবে সহায়তা করে দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি।

এক ব্যক্তির আয়ত্তে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরস্পরের খবরদারি করার মূল প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন নির্বাহী, সংসদ ও বিচার বিভাগ
আনা হলে জবাবদিহির মূল কাঠামো ভেঙে পড়ে। দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রশাসক বা সরকারের জবাবদিহি গ্রহণ অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রজাতন্ত্রে সাধারণ জনগণের কাছে প্রশাসকের জবাবদিহি গ্রহণের সর্বশেষ সুযোগ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনকে কুক্ষিগত করতে পারলে কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল নিজের পক্ষে নিয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা যায়। ভোটের বাস্তব কার্যকারিতা থাকে না। মানুষ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের অধিকার হারায়।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে স্বাধীন গণমাধ্যম রাজ্য শাসনে ভুলত্রুটি তুলে ধরে এবং নানাভাবে জনগণের পক্ষে শাসকের জবাবদিহি গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেখা যায়, জবাবদিহির ছিটেফোঁটাও মুছে ফেলার জন্য গণমাধ্যমের ওপর আঘাত হানা হয়। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদিকে নজরদারি ও বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয় এবং প্রয়োজনে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা বা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। জবাবদিহিহীন পরিবেশে প্রজাদের দেশের সম্পদের কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ভোটের মাধ্যমে শাসক পরিবর্তনের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এসব অধিকার হরণ করে নিজের আওতায় নিতে সক্ষম হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক একনায়ক ও প্রজাতন্ত্র একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত হন। একনায়কতন্ত্রে একনায়ক শাসকেরা সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে অবস্থান নেন এবং চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখল ও ভোগ করেন। সে দিক বিবেচনায় চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একনায়কতন্ত্র বহুলাংশে রাজতন্ত্রের মতো; একনায়ক শাসক রাজার সমতুল্য।

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো স্বেচ্ছাচার। একনায়ক প্রশাসক, স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। সে হিসেবে এ ধরনের শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরতন্ত্র বলা হয়। স্বৈরশাসক রাজার মতো তাঁর নিজ পরিবারের সদস্যদের ও বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতা বিলিবণ্টন করে একক নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে শাসন ও ভোগ করেন। স্বাভাবিকভাবে স্বৈরতন্ত্রে অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুশাসন পুঞ্জীভূত হয় এবং শাসনকার্যে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রাধান্য লাভ করে।

প্রায়ই স্বৈরশাসক জীবিত অবস্থায় তাঁর একনায়কতন্ত্রের উত্তরাধিকার ঠিক করে দেন। না হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজ পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে উত্তরাধিকার নির্বাচিত হন। একনায়কতন্ত্রে উত্তরাধিকার যখন পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে কে কোন পর্যায়ে মনোনীত হবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আনা হয়, দেশ হয় সম্পূর্ণরূপে রাজতন্ত্র। উত্তরাধিকার ঠিক করার বিধান করা বা না করা রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের একমাত্র উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। অন্য সব বৈশিষ্ট্যে একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্র এক ও অভিন্ন বলা যায়।

দেশের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের শিরোনাম ‘প্রজাতন্ত্র’। যেখানে ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র উল্লেখ আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল স্বাধীনতা। সংবিধান স্বাধীনতার অনন্য অর্জন। সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে ব্যত্যয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।

আজকের বাংলাদেশ বাস্তবে কতটুকু প্রজাতন্ত্র, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। সাধারণ জনগণের উপলব্ধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন পেছনে হাঁটছে। তাদের আশঙ্কা, দেশের মালিকানার অধিকার ক্রমান্বয়ে তাদের হাতছাড়া হয়ে পড়ছে। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরশাসন, রাজতন্ত্র, এক স্তর থেকে আরেক স্তরে রূপান্তরের প্রক্রিয়া ইত্যাদির উপসর্গ, লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।

পশ্চাৎমুখী রাজনীতিকে অগ্রগামী করে দেশের মালিকানা সাধারণ জনগণের মধ্যে স্থায়ী করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রজাদের দেশ পরিচালনায় অধিকার, দেশের সম্পদের ওপর মালিকানার অধিকার, ভোটের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। সেটাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন এবং দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। অন্যথায় ভয় হয়, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে শ্লথগতি, পুরোনো ও অনির্ভরযোগ্য গাড়ির মতো ধুঁকে ধুঁকে চলবে এবং যেকোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রতিটি সচেতন নাগরিক ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের দায়িত্ব এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে করণীয় ঠিক করা।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের: সাবেক মন্ত্রী, প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় পার্টি।