সভ্যতার রূপান্তরই ছিল তাঁর লক্ষ্য

এ পি জে আবদুল কালাম (১৯৩১–২০১৫) l ছবি: সাহাদাত পারভেজ
এ পি জে আবদুল কালাম (১৯৩১–২০১৫) l ছবি: সাহাদাত পারভেজ

প্রায় এক মাস আগের এক বিকেলে ড. কালামের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। তিনি থিরুভানানথাপুরামে ছিলেন, ওখানেই আমি থাকি, আমাকে তিনি রাজ ভবনে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। খাবারের তালিকা দেখেই তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়—সম্ভার, আভাইল, থোরান ও দই ভাত। সরল নিরামিষ খাবারের প্রতি পক্ষপাতের কারণে আমাদের অনেকেই তাঁকে কালাম আয়ার বলে ডাকতেন। আমরা সেদিন বাগানে পায়চারি করতে করতে তাঁর আগ্রহের বিষয় শিক্ষা নিয়ে বিস্তর কথা বলেছিলাম।
তিনি সব মানুষের মনকে উসকে দিতে চাইতেন, যত মানুষের বেলায় তা সম্ভব হয়। তিনি বলেছিলেন, আমার উচিত হবে ছাত্রদের পথ দেখানোয় নিজেকে নিয়োজিত করা, আর তরুণ ভারতীয়দের কাছে পৌঁছে যাওয়া। তিনি সভ্যতার রূপান্তরের কথা বলতেন। এই আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে এক দশক আগে দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সারগর্ভ আলোচনার কথা মনে পড়ে গেল, তখন তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। সময়টা ছিল সন্ধ্যার শেষের দিকে, আমরা তখন কেবলই রাতের খাওয়া শেষ করেছি। তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে মোগল বাগানে পায়চারি করতে বললেন। আমি যে চাঁদ অভিযান চন্দ্রায়ণ ১-এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, তখন সে সম্পর্কে খুব উত্তেজিত হয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমাদের যে রিমোট সেন্সিং ডেটা সংগ্রহ করার ছিল, সে বিষয়ে আমি তাঁকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, ‘আপনাদের উচিত হবে, চাঁদে ভারতের পতাকা লাগিয়ে দেওয়া, তা ছাড়া পৃথিবীর মানুষ কীভাবে বুঝবে, আপনার দেশের নভোচারীরা চাঁদে পদার্পণ করেছে।’ আমরা সেটা করেছিলাম। তিন বছর পরে লুনার অরবিটার যখন তার প্রোব পাঠাল, তখন ভারত পৃথিবীর মধ্যে কেবল চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে তার পতাকা উড়িয়েছে, পতাকার খুঁটিটি চাঁদের গায়ে কয়েক বর্গ ইঞ্চি গাড়া হয়েছিল। এখন এর নামকরণ করা হয়েছে জওহরলাল নেহরুর নামে।
কালামের যূথবদ্ধতার চেতনার সঙ্গে তাঁর উদারতা ও উদ্বেগের সামঞ্জস্য ছিল।
১৯৬৭ সালে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় থিরুভানানথাপুরামের থামবা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশনে, তার কয়েক দিন পরই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, তিনি আধুনিক ভারতের স্বপ্ন দেখেন। সেটা ছিল তাঁর মতো একজন মানুষের জন্য খুবই সাদামাটা এক শুরু, যিনি পরবর্তীকালে ভারতের বৈজ্ঞানিক মিশন ও প্রাযুক্তিক শক্তি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্যাপারটা কত সাদামাটা ছিল, তা আমাদের অফিস দেখলেই বোঝা যেত। এটা ছিল সেন্ট মেরি ম্যাগাডেলিনের গির্জা। আর ওয়ার্কশপটি ছিল এক স্থানীয় পাদরির বাড়িতে। তিনি খুব সৌজন্যতার সঙ্গে ভবনটিকে ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির মোহিনি রকেট মিশনকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। কালামের নেতৃত্বে সেখানেই আমরা দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি, অহংকার করার মতো এক ডিজাইন প্রণয়নে আমরা কাজ করেছি। এ প্রক্রিয়ায় তিনি আমাদের ভেতর থেকে শক্তির প্রতিটি কণা পর্যন্ত বের করে নিয়েছেন।
আমি তখন ছিলাম একজন প্রোগ্রাম প্রকৌশলী, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় আমার ঢের জ্ঞান ছিল। তখন আমি শুধু বিজ্ঞানেই নিমজ্জিত ছিলাম। কালাম আমাদের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করতেন। কিন্তু আমরা যখন কাজে ডুবে থাকতাম, তিনি দেখতেন, যাতে কোনো কিছু আমাদের মনোযোগে চিড় ধরাতে না পারে। একদিন আমার ছেলে দিলীপন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কালাম তাঁর কার্যালয়ের ফোনে কথা বলে তাঁর সহকারীকে পাঠিয়ে আমার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন। আর দিনের কাজ শেষ হওয়ার পরই তিনি আমাকে ওই বিষয়ে অবহিত করেন। তাঁর কাজে মানবতা ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রচণ্ড রকম ভাস্বর বুদ্ধিমত্তা।
আমার মনে হয়, কালাম এটাই রেখে গেছেন। অন্য কথায়, তাঁর এই গুণ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর দৃষ্টিগ্রাহ্য অর্জনের বাইরে গেলে দেখবেন, কালাম আধুনিক ভারতের সঙ্গে স্বনির্ভরতার চেতনা যুক্ত করেছিলেন। সেই থামার দিনগুলোতে মানুষ ১০ কিলোমিটার যেতে পারে, এমন রকেটের কথা ভাবত, তখনই তিনি এর চেয়ে ৪০ গুণ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলেছেন। ভারত যখন রাশিয়ার উদার দানের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তখনই কালাম কল্পনা করতেন, ভারতের আকাশে দেশে বানানো বিমান উড়বে, আর দেশের সীমান্ত রক্ষিত হবে দেশে নির্মিত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে। তিনি এমন ধারার এক ভবিষ্যতের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; মুম্বাইমিরর থেকে নেওয়া
মাধবন নায়ার: ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সাবেক চেয়ারম্যান।