জাপানি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী

জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বাংলাদেশের আবির্ভাবের পটভূমি তৈরি করে দেওয়া ভারত বিভাগ থেকে শুরু করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সূচনালগ্নে পাকিস্তানের রাজনীতির নানা রকম ঘটনা ও সেই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর কূটচালের সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ যে ইতিহাস বঙ্গবন্ধু রচনা করে গেছেন, তাঁর সহজ ভাষা ও অলংকারবর্জিত বর্ণনার মধ্য দিয়ে তা এখন জাপানি পাঠকদের সামনে উপস্থিত করছে জাপানের নেতৃস্থানীয় শিক্ষা ও গবেষণামূলক বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা আকাশি শোতেন। সেদিক থেকে বইয়ের এই বিদেশি ভাষার অনুবাদকে ব্যতিক্রমী এ কারণে আখ্যায়িত করতে হয় যে জাপানে যেসব ছাত্র ও গবেষক বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতে সেই কাজে জড়িত হবেন, তাঁদের কাছে গবেষণার আবশ্যকীয় একটি উপাদান হয়ে উঠবে এ বই। আকাশি শোতেনের মতো নামী এক প্রকাশনা সংস্থার এ উদ্যোগ তাই প্রশংসার দাবি রাখে।
উল্লেখ্য, জাপানের এই প্রকাশনা সংস্থা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও ইতিহাসের ওপর লেখা বই প্রকাশ করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বকে জাপানের পাঠক-গবেষকদের কাছে পরিচিত করে তোলায় অনেক দিন থেকে নিয়োজিত আছে এবং সেই মহৎ দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে এই প্রকাশনা কোম্পানি এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেছে। বাংলাদেশের ওপর এদের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ হচ্ছে বাংলাদেশবিষয়ক দুই গবেষক মাইয়ুমি মুরাইয়ামা ও মাসাআকি ওহাশি সম্পাদিত প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক জাপানি রাষ্ট্রদূত মাৎসুশিরো হোরিগুচির লেখা প্রামাণ্যগ্রন্থ বাংলাদেশের ইতিহাস।
জাপানে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৫ হাজার বই প্রকাশিত হয়। সেই হিসাবে প্রতিদিন দুই শতাধিক বই জাপানে বইয়ের বাজারে আসছে। ফলে মোড়ক উন্মোচন করে নতুন বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের প্রচলন জাপানে নেই। নামী লেখকদের বেলায় যেটা হয় তা হলো, বই বাজারে আসার প্রথম কয়েকটি দিন পাঠকদের জন্য নতুন বইয়ে নাম স্বাক্ষরের বিশেষ আয়োজনে তাঁদের উপস্থিত থাকা। এ ছাড়া অগ্রসর অন্যান্য দেশের মতো জাপানের প্রকাশনা কোম্পানিও নতুন বইয়ের প্রকাশনার বেলায় যা করে থাকে তা হলো, সংবাদমাধ্যমে নতুন বইয়ের বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর পাশাপাশি সেই সব বইয়ের কিছু কপি পর্যালোচনার জন্য জমা দেওয়া। জাপানি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বেলায়ও আকাশি শোতেন একই পথ অবলম্বন করেছে।
তবে বাংলাদেশে ভিন্ন যে আয়োজন এ জন্য করা হচ্ছে তা হলো, জাপানি ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের কয়েকটি কপি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করার মধ্য দিয়ে বইটি প্রকাশের বার্তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আগামীকাল ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত বিশেষ সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন প্রকাশনা সংস্থা আকাশি শোতেনের প্রেসিডেন্ট ও সেই সঙ্গে বইয়ের জাপানি অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর জাপানি অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি অনুবাদের জন্য পরিচিত। তাঁর অনুবাদে ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছে জাপানের প্রয়াত রাজনীতিবিদ তাকাশি হায়াকাওয়ার লেখা আমার বাংলাদেশ এবং জাপানে রেডক্রসের সাবেক কর্মী তাদামাসা ফুকিউরার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতি রক্ত ও কাদা ১৯৭১। এ ছাড়া বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় করা তাঁর কিছু অনুবাদও ইতিমধ্যে জাপানের কয়েকটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী হচ্ছে কাজুহিরো ওয়াতানাবের করা পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থের জাপানি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত অনুবাদ।
বইটি অনুবাদের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ইতিহাসের কিছু কিছু অধ্যায় আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ কাজুহিরো ওয়াতানাবের হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে কী অনুভূতি তাঁর হয়েছিল। কাজুহিরো ওয়াতানাবে বলেছেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অনুবাদের কাজ করার সময় আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একেবারে পাশে বসে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনছি। বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্রে ও ইন্টারনেট ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে কথা বলতে ও ভাষণ দিতে দেখি, ঠিক সেভাবেই সহজ-সরল ও অন্তরঙ্গ ভাষায় তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর স্মৃতিকথাগুলো এই রচনায়। এ রকম প্রাণবন্ত লেখা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা ছিল আমার কাছে বড় আনন্দের কাজ।’
কাজুহিরো ওয়াতানাবে আরও জানিয়েছেন যে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করায় তিনি জড়িত বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ও দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা তাঁর থেকে থাকলেও সেসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানার সুযোগ বইটি তাঁর জন্য করে দিয়েছে।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর থেকে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সব সময় হচ্ছে বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর। আর ইদানীং সেই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হওয়ার মধ্য দিয়ে দুই দেশের অর্থনৈতিক বন্ধনকে তা করে তুলছে আরও বেশি শক্তিশালী ও অর্থবহ। ফলে অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে মনে করেন যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সে রকম এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের জাতির পিতার লিখে যাওয়া আখ্যান পাঠ করা জাপানিদের জন্য বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পেতে সহায়ক হবে। আর অনুবাদক হিসেবে তাঁর নিজের পরিতৃপ্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘অনূদিত বইটি পড়ে কোনো জাপানি পাঠকের মনে বাংলাদেশের ইতিহাস ও আদর্শ নিয়ে যদি আরও জানার আগ্রহ তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে অনুবাদক হিসেবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী জাপানের পাঠকদের সামনে উপস্থিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন এক পরিচিতি অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে ও প্রকাশনা সংস্থা আকাশি শোতেন জাপানে তুলে ধরায় সাহায্য করছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিক ধন্যবাদ তাঁদের প্রাপ্য। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার মাসে মর্মান্তিক সেই ঘটনার ৪০ বছর পর বইয়ের জাপানি অনুবাদ সেই দেশের একটি নামী প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশ করা আবারও যে সত্য আমাদের সামনে উপস্থিত করছে তা হলো, ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়ার অপপ্রয়াস গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কখনোই টেকসই হয় না, বরং বুমেরাং হয়ে তা সেই অপপ্রয়াস যারা চালায়, তাদেরই ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি হারিয়ে যাওয়ার নন, বরং সময়ের পথচলায় আরও বেশি জীবন্ত, আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে বারবার তিনি ফিরে আসেন মানুষের কাতারে।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷