পৃথিবীকে ছিঁড়েখুঁড়ে একাকারের মহোৎসব!

সম্প্রতি লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়ামে একটা সেমিনারে গেলাম। বিষয় ‘এনথ্রোপোসিন’ (Anthropocene)। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ, বিশ্ব উষ্ণায়ন ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে বিষয়টা পরিচিত। পৃথিবী গ্রহের লাখ লাখ বছরের জলবায়ু, ভূতত্ত্ব নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা লক্ষ করেছেন যে পৃথিবীর আবহাওয়ার বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে মূলত নানা রকম প্রাকৃতিক কারণে। হিমপ্রবাহ, প্রবল ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির বিকট অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি পৃথিবীর চেহারা বদলে দিয়েছে। তুষার যুগে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহু প্রাণী, এমনকি অতিকায় ডাইনোসর। প্রবল ভূমিকম্পে বদলে গেছে নদীর গতিপথ, যেমন আমাদের ব্রহ্মপুত্র। পৃথিবীর পৃষ্ঠে দেখা দিয়েছে নতুন পর্বতমালা, যেমন হিমালয়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে হারিয়ে গেছে রমরমা নগর, যেমন পম্পেই।
প্রকৃতিই বদলে দিয়েছে প্রকৃতিকে। এসব একেকটা পরিবর্তন ঘটেছে হাজার বছরের ব্যবধানে। কিন্তু সম্প্রতি গবেষকেরা লক্ষ করছেন গত মাত্র দেড় শ-দুই শ বছরের ব্যবধানে পৃথিবীর আবহাওয়া, জলবায়ু, ভূত্বকের একটা বড় পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। এবং এই পরিবর্তনটা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘটছে না, ঘটছে মানুষের হাতে। কোনো হিমপ্রবাহ নয়, ভূমিকম্প নয়, অগ্ন্যুৎপাত নয়, বরং মানুষ নিজের হাতে নিজের বাসস্থান এই পৃথিবী গ্রহটাকে বিপজ্জনকভাবে বদলে ফেলছে। এই পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে ‘এনথ্রোপোসিন’। গ্রিক শব্দ ‘এনথ্রোপ’-এর অর্থ মানুষ আর ‘সিন’ অর্থ নতুন। পৃথিবীকে নিয়ে মানুষের নতুন কাণ্ড।
প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ইয়ান জালাসিয়েভিস বলছিলেন কীভাবে প্রাচীন ইতিহাসে মানুষ একটা সময় প্রকৃতির কাছে কাবু ছিল, তারপর তারা প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে শিখল। এরপর তারা শুরু করল প্রকৃতিকে জয় করতে। একপর্যায়ে প্রকৃতিকে জয় করার নেশা প্রকৃতিকে গ্রাস করার নেশায় পর্যবসিত হলো। পৃথিবীপৃষ্ঠের অন্যান্য প্রাণী পৃথিবীকে খুঁড়তে পারত সামান্য কিছু দূর পর্যন্ত। ইঁদুর হয়তো ইঞ্চি খানেক গর্ত খুঁড়তে পারত, খরগোশ হয়তো ফুট খানেক। কিন্তু মানুষ তার লোভের ধন খুঁজতে পৃথিবী খুঁড়ে চলে গেল মাটির নিচে মাইলের পর মাইল। শুধু মাটির নিচে নয়, মাটির ওপরেও যেখানে যা কিছু আছে তা নিজের দখলে নেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠল মানুষ। পৃথিবীর তলা খুঁড়ে তুলে আনল কয়লা, তেল, সোনাদানা। বড় বড় বাঁধ দিয়ে বদলে দিল নদীর গতিপথ, বন কেটে, পাহাড়-পর্বত কেটে বানিয়ে তুলল ইট-কংক্রিটের নগর।
গত দেড় শ-দুই শ বছর পৃথিবী গ্রহকে ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করার এই মহোৎসব চলছে। লাখো কোটি বছরের পুরোনো এই পৃথিবীর ওপর এমন অত্যাচার এর আগে আর ঘটেনি। মানুষ ভুলে গেছে তার আরাম, আনন্দ। গতির জন্য প্রযুক্তিকে যেভাবে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করা হচ্ছে, যে ধারার নগর তৈরি করা হচ্ছে, তার সব কাঁচামাল সরবরাহ করছে এই পৃথিবীর প্রকৃতি আর প্রাণিজগৎ। কিন্তু পৃথিবীর সম্পদ তো অসীম নয়। জালাসিয়েভিস হিসাব করে দেখালেন পৃথিবীর সব মানুষকে যদি আজকের যাবতীয় আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে হয়, পৃথিবীর সব এলাকাতে যদি একই ধারার নগরায়ণ করতে হয়, তাহলে কোনোভাবেই এই পৃথিবীর কাঁচামাল দিয়ে তা হবে না। তিনি অঙ্ক করে দেখালেন যে এ জন্য আরও অন্তত দুই-একটা এমন আস্ত পৃথিবীর দরকার।

>পৃথিবীকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে গেলে আমাদের পৃথিবীকে গ্রাস করার এই প্রক্রিয়ার লাগাম টানতে হবে আর সেই লাগাম টানলেই জীবনযাপনের একটা নতুন ধরন আমাদের ভাবতে হবে। এই জীবন মানে কি তাহলে অরণ্যের আদিমতায় ফিরে যাওয়া? মোটেও তা নয়

মানুষের দাপটে ইতিমধ্যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অগণিত প্রাণী, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বৃক্ষ, ফুটো হয়ে গেছে ওজোনস্তর। মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ঠ পৃথিবী এবার তার ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে, উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীতল, অসময়ে দেখা দিচ্ছে সুনামি, বন্যা; অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে আবহাওয়া। গবেষকেরা বলছেন, একটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। ভূমিকম্পের ব্যাপারে, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ব্যাপারে, সুনামির ব্যাপারে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা মানুষের হাতেই ঘটছে। ফলে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ এখন মানুষেরই হাতে।
সেমিনারে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী বললেন, এই যে জলবায়ুর সংকট, ভূত্বকের সংকটের কথা আমরা বলছি, এর মূলে আসলে রয়েছে দার্শনিক সংকট, ইতিহাসের সংকট। আমরা কোন পৃথিবী, কোন সমাজ চাই, সেই আদর্শিক প্রশ্ন মীমাংসা না করলে জলবায়ুর সংকট নিরসন সম্ভব নয়। এই যে পৃথিবীকে ছিঁড়েখুঁড়ে নেওয়ার মহোৎসব, তা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লব ও তার পরবর্তী ঔপনিবেশিক শাসনের কালে। এনলাইটেনমেন্ট ধারণার আলোকে ইউরোপ যে সভ্যতার আদর্শ তৈরি করেছে, ক্রমেই বাজার অর্থনীতির পথ ধরে তা এক ব্যক্তিসর্বস্ব, ভোগসর্বস্ব সমাজে পর্যবসিত হয়েছে।
কিন্তু যাঁরা এই বাজার অর্থনীতির বিপক্ষে এক বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজের কথা বলছেন, তাঁদের বিবেচনায়ও এই পৃথিবী গ্রহ নেই। তাঁদের ভাবনা কেবলই মানুষ ও তার সমাজকেন্দ্রিক। তাঁরা কেবলই এক বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পশ্চিমা সভ্যতা বস্তুগত জীবনযাপনের যে আদর্শ তৈরি করেছে, বৈষম্যহীনভাবে সেই জীবনযাপনের ওপর সবার অধিকার প্রতিষ্ঠাই কি সাম্যবাদী সমাজ আন্দোলনের মূল কথা? বৈষম্য সংকটের একটা দিক কিন্তু আরও বড় দিক হচ্ছে ভাবনাকে শুধু মানুষ ও তার সমাজকেন্দ্রিক রাখা। পুরো পৃথিবী গ্রহকে কেন্দ্রে রেখে যদি আমরা আমাদের সমাজ-ভাবনাকে সাজাই, তাহলে মাটি, নদী, আকাশ, প্রাণী ইত্যাদিকে তাদের ন্যায্য হিস্যা দিয়ে আমাদের মনুষ্য সমাজ গড়তে হবে।
পৃথিবীকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে গেলে আমাদের পৃথিবীকে গ্রাস করার এই প্রক্রিয়ার লাগাম টানতে হবে আর সেই লাগাম টানলেই জীবনযাপনের একটা নতুন ধরন আমাদের ভাবতে হবে। এই জীবন মানে কি তাহলে অরণ্যের আদিমতায় ফিরে যাওয়া? মোটেও তা নয়। বরং এ জীবন হতে হবে এমন, যা প্রকৃতিকে সম্মান জানিয়ে, আমাদের লোভের লাগাম টেনে আরও একটু স্নিগ্ধ, আরও একটু আলতোভাবে আমাদের বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করবে। পশ্চিমা সভ্যতা আমাদের সামনে জীবনযাপনের যে আদর্শ স্থাপন করেছে, তাতে তেমন প্রকৃতিবান্ধব বিনীত জীবন সম্ভব নয়। দীপেশ চক্রবর্তী সাব অলটার্ন তত্ত্বের অন্যতম দার্শনিক। তিনি বিকল্প আধুনিকতার কথা বলেন। সেই আধুনিকতার ভাবনায় প্রাচ্য, পাশ্চাত্য দর্শনের সংশ্লেষ করার কথা আছে। সেসব হয়তো বহু প্রজন্মের কাজ কিন্তু ভাবনাটা তো কোনো এক জায়গা থেকে শুরু করতে হবে, এই তাঁর প্রস্তাব।
সেমিনার শুনতে শুনতে ভাবছিলাম কবি যে বলেছেন, ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’—এ কথার বিপদ আছে। মানুষ্য সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা নিঃসন্দেহে জরুরি। কারণ, তা মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরোধিতা করে। কিন্তু পুরো পৃথিবী গ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথাকে মেনে চললে তা আমাদের সেই পথেই টেনে নেবে, যেখানে মানুষ নিজেকেই একমাত্র সত্য জেনে পৃথিবী গ্রহটাকে ছিঁড়ে-খুবলে খেতে থাকবে শুধু। হয়ে উঠবে এক মানুষ রাক্ষস।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]