বাংলাদেশের গণহত্যাকে আমলেই নেননি নিক্সন

টিম উইনার
টিম উইনার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন—এ কথা সবার জানা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে কীভাবে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি দখলদার পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সহায়তা করেছেন, তারও অকাট্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার নীতি নিয়েছিলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অতন্দ্র প্রহরী দেশটির প্রেসিডেন্ট। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাবেক নিরাপত্তাবিষয়ক সংবাদদাতা টিম উইনারের সর্বশেষ বই ওয়ানম্যান অ্যাগেইনস্ট দ্য ওয়ার্ল্ড: দ্য ট্র্যাজেডি অব রিচার্ড নিক্সন-এ এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এই সাংবাদিক লিগ্যাসি অব অ্যাসিস: দ্য হিস্টরি অব দ্য সিআই-এ লিখে ১৯৮৮ সালে পুলিৎজার ও ২০০৭ সালে ন্যাশনাল বুক পুরস্কার লাভ করেন।
গ্যারি জে বাস তাঁর ব্লাড টেলিগ্রাম-এ দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিক্সনের কী ভূমিকা ছিল। বাস লিখেছেন, তখন বিশ্বটা ছিল একটি পরাশক্তির দাবার বোর্ড, যেখানে লাখ লাখ বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিক ও শরণার্থীর জীবন বন্ধক রাখার চেয়েও বেশি কিছু ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং আড়াই লাখের মতো নারী ধর্ষিত হন। কিন্তু নিক্সনের কাছে তাদের আত্মদান ও ত্যাগ কোনো গুরুত্বই পায়নি।
২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হোয়াইট হাউস, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল, সিআইএ, এফবিআই পররাষ্ট্র দপ্তরের হাজার হাজার নথিপত্র এবং ২০১৩-২০১৪ সালে অবমুক্ত হওয়া নিক্সনের শত শত ঘণ্টার কথোপকথনের টেপ জনগণের জন্য মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে টিম উইনার লিখেছেন, নিক্সন ও তাঁর তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার (পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তা ও তথ্য-প্রমাণ ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রাহ্য ও অবমূল্যায়ন করেছেন। নিক্সন সব সময় আতঙ্কে থাকতেন; আর এই আতঙ্ক তাঁকে ক্রুদ্ধ করত এবং সেই ক্রুদ্ধতা আত্মবিনাশের পথে নিয়ে যেত। উইনারের ভাষায়, নিক্সন দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। ভিয়েতনামে তাঁর যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল বি-৫২ বোমারু বিমান, আর দেশের ভেতরে তাঁর ছিল আড়ি পাতা, গোয়েন্দাদের বিভিন্ন অপকর্মে নিয়োজিত করা ও চুরিচামারি।
নিক্সন আরও লিখেছেন, দুই যুদ্ধই আসলে এক যুদ্ধ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ওয়াটার গেটকে অনিবার্য করে তোলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক আমেরিকানকে জীবন দিতে হয়েছে। সেখানে পাঁচ লাখ মার্কিন সেনা মারা গেছেন। কিন্তু নিক্সন বলতে পারেননি এটা কীভাবে সামাল দেবেন। এমনকি তাঁর নীতির বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটিও স্পষ্ট করতে পারেননি তিনি।
এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়া টিম উইনারের সাক্ষাৎকার নেয়; যাতে তৎকালীন মার্কিন সরকারের অনেক দুরভিসন্ধি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল: কেন নিক্সন ও কিসিঞ্জার লাখ লাখ বাঙালির গণহত্যার বিষয়টি অগ্রাহ্য করেছেন? জবাবে উইনার বলেন, ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীনের দরজা খুলে দেওয়ার বিনিময়ে নিক্সন এটি করেছেন। এই যুদ্ধে পাকিস্তান জিতবে না জেনেও নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র তাদের সমর্থন করে গেছে।

.
.

যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে টিম লিখেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেরও দুটি দিক ছিল। দেশের ভেতরের যুদ্ধটি ছিল পেন্টাগনের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ, হোয়াইট হাউস ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মধ্যে। নিক্সন এঁদের কাউকে বিশ্বাস করতেন না। পরবর্তীকালে তাঁরাও তাঁকে বিশ্বাস করতেন না। বাহিনীর প্রধানেরা মনে করতেন, পাকিস্তানিদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া ছিল মারাত্মক ভুল এবং ভারতের বিরুদ্ধে চীনা কার্ড খোলার বিষয়টিও তাঁদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। নিক্সনের অপমানজনক পদত্যাগের পর তাঁর উত্তরসূরি জেরাল্ড ফোর্ড জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাদের দীর্ঘ জাতীয় দুঃস্বপ্নের অবসান হয়েছে।’ তবে তিনি নিক্সনকে ওয়াটার গেট মামলা থেকে দায়মুক্তি দেন।
টিম উইনার বলেছেন, ‘সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। যদিও সেখানে এখনো সেই অপরাধের দায়ে অপরাধীদের বিচার হচ্ছে এবং শাস্তি পাচ্ছে। নিক্সন অযৌক্তিকভাবে ভারতকে ঘৃণা করতেন। তিনি ভারতবাসীকে বর্বর ও নরখাদক বলে গালাগাল করতেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ।
টিম উইনারের বই থেকে আরও জানা যায় যে বাংলাদেশে যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রবেশ না করে, সে জন্য নিক্সন-কিসিঞ্জার চীনকে ভারত আক্রমণে প্ররোচিত করেছিলেন, যা মানব সম্প্রদায়কে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারত। উইনার লিখেছেন, নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ছিলেন চরম অসহিষ্ণু এবং তাঁকে ‘কুক্কুরী’ বলে গাল দিতেও দ্বিধা করেননি। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইন্দিরা সম্পর্কে নিক্সনের অশোভন মন্তব্যের জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছে। ইয়াহিয়ার পরাজয় এবং ইন্দিরার শক্তি বৃদ্ধিতে মর্মাহত হয়েছিলেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার পর নিক্সন তাঁর প্রথম ইউনিয়ন ভাষণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নির্বিঘ্ন শান্তির সুবর্ণ সুযোগ বলে অভিহিত করলেও তিনি কখনোই শান্তিতে ছিলেন না। তিনি ভেবেছেন গোটা বিশ্ব তাঁর বিরুদ্ধে। সর্বত্র তাঁর শত্রু। ফলে তাঁর মহত্ত্ব ঔদ্ধত্যে পরিণত হয়েছে।
১৯৭১ সালের মে মাসে নিক্সন বলেছিলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত সেই সব সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলেছি যে যারা মূলত আমাদের প্রতি বৈরী। চীনারা আমাকে উৎখাত করতে চায়। রাশিয়ার নেতারা হলেন দস্যুদলের সরদার। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস রয়েছে। নিক্সন আমেরিকান জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সম্মানজনকভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন; কিন্তু সেটি করতে পারেননি।
টিম উইনারের ভাষায়, নিক্সন সারা জীবন কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইলেও কমিউনিস্ট দেশ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে তাঁকে সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে হয়েছে। তিনি তাদের সদিচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে ভিয়েতনাম থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে তারা তাঁকে সহায়তা করবে কিন্তু তিনি পরাজিত হয়েছেন। তিনি কমিউনিস্ট সরকারগুলোর সঙ্গে যুক্ত ইশতেহার ও চুক্তি সই করেছেন; কিন্তু শান্তি-সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। রাশিয়া ও চীন তখনো আমেরিকার বৃহত্তম শত্রু ছিল, আজও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী।
তাঁর সময়ের সিআইএর প্রধান রিচার্ড হেলম লিখেছেন, নিক্সন কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতো আরও অনেকে, যাঁরা প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, তাঁদেরও না। তিনি জনগণকে বলতেন, বিমানবাহিনী ভিয়েতনামে বোমা ফেলে তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। পররাষ্ট্র দপ্তরের চোস্ত পোশাক পরা ও ককটেল পার্টিতে যোগ দেওয়া কূটনীতিকেরা কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভিয়েতনাম জয়ের পথ বাতলাতে পারেনি। হেলম নিক্সনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, তাঁরা কাপুরুষ, তাঁরা নির্বোধ; তাঁরা এটাও পারেন না, ওটাও পারেন না। নিক্সন মনে করতেন যে আমেরিকায় যাঁরা যুদ্ধবিরোধী সভা-সমাবেশ করেছেন, আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের পঞ্চম বাহিনী এবং সোভিয়েত, চীনা, উত্তর ভিয়েতনাম ও কিউবানরা তাঁদের গোপনে অর্থের জোগান দেয়।
ওয়াশিংটন এবং সারা বিশ্বে যে সংঘাত চলছিল, তাকে নিক্সন দেখেছিলেন সাংবিধানিক সংকট হিসেবে। গৃহযুদ্ধ চলাকালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গ্রেপ্তারকৃত যেকোনো ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার বিধান স্থগিত করেছিলেন; লিঙ্কনের এই আদেশ ছিল অসাংবিধানিক। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন এবং নিক্সনও একমত যে জাতিকে রক্ষা করতে প্রেসিডেন্টের আইন ভঙ্গ করার অধিকার আছে। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট যখন এটি করেন, তার অর্থ এটি বেআইনি নয়। নিক্সন ভিয়েতনাম যুদ্ধকেও লিঙ্কনের সময়ের গৃহযুদ্ধের অবস্থার সমতুল্য বলে মনে করতেন। ফলে জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নিক্সন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে আদালতে কংগ্রেস এবং অবশ্যই নাগরিকদের পক্ষ থেকে কেউ প্রশ্ন করতে পারতেন না। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করতে গিয়ে তিনি আমেরিকান সেনাদের ও গোয়েন্দাদের বিদেশে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। গুপ্ত পুলিশকে আমেরিকান নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তি, তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা, তাদের টেলিফোন কথোপকথন টেপ করা, তাদের অফিসে আড়ি পাতার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। নিক্সনের কাছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতাকারী প্রত্যেক মার্কিন নাগরিক ও নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন শত্রু। তিনি ভাবতেন, গোটা বিশ্ব তাঁর বিরুদ্ধে।
নিক্সন ছিলেন অতিমাত্রায় মদ্যপ। তিনি ইনসোমনিয়ায় ভুগতেন বলে ঘুম হতো না। সে কারণে রাতে অঢেল মদপান করে দিনের বেলায় ঘুমাতেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক ছিল। ওয়াশিংটন আরও জানতে পারে যে সোভিয়েত পারমাণবিক অস্ত্রবোঝাই রণতরি মিসরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। ২৪ অক্টোবর হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে জরুরি বৈঠকে হেনরি কিসিঞ্জার, যৌথ বাহিনীর চেয়ারম্যান টম মুরের, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সিআইএর প্রধান বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও প্রেসিডেন্টের দেখা নেই। ওই বৈঠকে একজন বলেন, ‘আমরা এখানে কী করতে যাচ্ছি? সোভিয়েতরা ভাবছে, আমাদের কোনো কর্মক্ষম প্রেসিডেন্ট নেই।’ যৌথ বাহিনীর চেয়ারম্যান লিখেছেন, ‘সোভিয়েতরা যদি ১০ হাজার সেনা মিসরে ঢুকিয়ে দেয়, আমরা কী করব? উত্তর হলো: আমাদের কিছুই করার নেই। কেননা, আমাদের কর্মক্ষম কোনো প্রেসিডেন্ট নেই।’
১৯৭৩ সালের ২৪ অক্টোবরই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিক্সনই আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি অবমাননাকরভাবে পদত্যাগ করেছেন। যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এটা প্রমাণিত যে তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়েছিলেন। তিনি কাউকে বিশ্বাস করতেন না—তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, কংগ্রেস কিংবা যৌথ বাহিনীর প্রধান, এমনকি আমেরিকান নাগরিকদেরও নয়।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর স্বৈরশাসকেরা যে ধরনের জবরদস্তি করে থাকেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যত অসাংবিধানিক পন্থা অবলম্বন করে থাকেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির প্রধান তার থেকে কম কিছু করেননি। অন্তত টিম উইনারের বই সেই সাক্ষ্য দেয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]