গভীর সমুদ্রবন্দরের গভীরে

.
.

বর্তমান নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ২০০৯ সালেও একই দায়িত্বে ছিলেন। সে বছরের অক্টোবর মাসে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ২০১৬ সালে বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। এখন ২০১৫ সাল। এ বছরের জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় (গত ৪ জুন) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আটটি বড় প্রকল্পকে ‘দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িতব্য’ বা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে রেখেছেন। এর মধ্যে দুটিই সমুদ৶বন্দর—একটি ‘গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প’, অপরটি ‘পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প’। এই আট প্রকল্পের দুটি পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারের চলতি মেয়াদে শেষ হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। মানে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এ দুটির কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আমরা আরও নিশ্চিত হলাম যে ২০১৯ সালের মধ্যে আর যা-ই হোক, গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ কোনো পর্যায়েই শেষ হবে না। ২০১৬-তে যা হওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল, তা ২০১৯ সালেও হচ্ছে না।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিংচিয়াং সম্প্রতি প্রথম আলোর কার্যালয়ে এসেছিলেন। খোলামেলা কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক, বিশ্ব রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চীনের বিস্ময়কর উন্নয়ন—এ সবই ছিল কথাবার্তার বিষয়। গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হবে—এমনটিই ধারণা করা হয়েছিল। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিএইচইসি) এর কাজ পেতে যাচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবরও বের হয়েছিল। অর্থায়ন করার কথা ছিল চীন সরকারের। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছিল এ প্রসঙ্গও।
কোনো সন্দেহ নেই যে গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসা এই চীনা রাষ্ট্রদূত একজন পাকা কূটনীতিক। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর ও চীন প্রসঙ্গটিও সামলালেন কূটনৈতিকভাবেই। গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই না হওয়া তাঁর কাছে ‘বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের বিষয়’। তিনি বরং এ ধরনের একটি বন্দর আমাদের জন্য কেন ও কতটা দরকারি, সেটাই বোঝালেন। বললেন, যারাই করুক, বাংলাদেশের উচিত এই বন্দর বানানোর কাজ শুরু করা এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। শেষে এটা বলতেও ভুল করলেন না যে তাঁর দেশের কোম্পানি কাজটি পেলে চীন খুশি হবে।
এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতটা জরুরি, সেটা আমাদের নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। সিঙ্গাপুরের মতো দেশের তো আয়-রোজগারের বড় একটি খাত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। তাত্ত্বিকভাবে সমুদ্রবন্দর হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো, যা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব ফেলে। এটা রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে ওঠা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয় বাড়াতে জোর ভূমিকা রাখে। এ ধরনের একটি গভীর সমুদ্রবন্দর শুধু স্থানীয় বা জাতীয় নয়, আঞ্চলিক অর্থনীতির জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই দেশটির জন্য এক বড় সুযোগের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের এমন জায়গায়, যার আশপাশের দেশগুলোর অনেক অঞ্চল পুরোপুরি ভূমিবেষ্টিত, সমুদ্রের প্রবেশাধিকার নেই। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হলে সাত উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য, নেপাল, ভুটান, চীনের কুনমিং বা মিয়ানমারের শান ও রাখাইন রাজ্য এর সুফল পেতে কাজে লাগাতে পারবে।
সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে ‘গভীর সমুদ্রবন্দর’ থাকলেও এ নিয়ে বিভ্রান্তিই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনায় (এটাও সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকে রয়েছে) মজুতের সুবিধাসহ কয়লা আমদানির জন্য একটি বন্দর বানানের কথা বলা হয়েছে। জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এর কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে। ‘প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর সোনাদিয়া থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। দুটি ক্ষুদ্র দ্বীপের এই সামান্য দূরত্বের কথা বিবেচনা করে সরকার সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করেছে।’ এই মন্তব্য পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের। (ঢাকা ট্রিবিউন, ১১ জানুয়ারি, ২০১৫)। তিনি জানিয়েছেন, এই নতুন বাস্তবতায় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে আরও স্টাডি দরকার এবং প্রয়োজনে মাতারবাড়ীকে সোনাদিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে, পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরকেও ‘ফাস্ট ট্র্যাকে’ রেখে সরকার এগোনোর চেষ্টা করছে। এটাকেও গভীর সমুদ্রবন্দরে পরিণত করার কথা ভাবা হচ্ছে। ফলে কোথায় বা কোনটি একটি পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দর হতে যাচ্ছে বা দেশে একাধিক গভীর সমুদ্রবন্দর হতে যাচ্ছে কি না, তা এখন এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ আসলে শুধু একটি বড় বিনিয়োগ বা অবকাঠামো নির্মাণের বিষয় নয়। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর কারা বানাল, তা বন্দরটি ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভূরাজনীতির বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত জুনে সব ঠিকঠাক হওয়ার পরও চীনের সঙ্গে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর থেকে বাংলাদেশের সরে আসার পেছনে এসব কৌশলগত নানা বিবেচনা কাজ করেছে। চীনের হাত দিয়ে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হোক, সেটা অনেকেই চায় না। পরিকল্পনামন্ত্রী পরিষ্কার করেই বলেছেন, ‘ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ চীনের জড়িত হওয়ার বিরুদ্ধে।’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ১১ জানুয়ারি ২০১৫)। এটা এখন পরিষ্কার যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির নানা জটিল হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর।
নিউইয়র্কভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক অনলাইন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ নিউজের গত ২৪ জুনের একটি শিরোনাম হচ্ছে, ‘ভারত মহাসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ দৌড়ে জাপান চীনকে হারিয়ে দিয়েছে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত মহাসাগরে জায়গা করে নেওয়ার ধাক্কাধাক্কিতে এই অঞ্চলের শক্তিগুলোর মধ্যে জাপান চীনকে হারিয়েছে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ব্লুমবার্গ নিউজের মেইলের জবাবে নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের মাতারবাড়ীতে আগামী জানুয়ারিতে ১৮ মিটার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এই তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে যে চীনের জন্য এটা একটি খারাপ খবর। কারণ, চীন এর মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল।
ব্লুমবার্গ নিউজের প্রতিবেদনে সমুদ্র-বাণিজ্য বিশ্লেষক ক্রিসপেন এটকিনসনকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি ওই অঞ্চলে মাত্র একটি সমুদ্রবন্দরের সম্ভাবনা দেখি।’ তাঁর মতে, বাংলাদেশের ‘এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক। আপনি যদি একটি সমুদ্রবন্দর বানাতে চান এবং একই সঙ্গে পশ্চিমা সমর্থনও চান, তাহলে চীনের টাকায় বন্দর নির্মাণ কী ভালো বিকল্প?’ তাঁর প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে। মাতারবাড়ীতে আগামী বছরের জানুয়ারিতে যে বন্দরের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে জাপানের অর্থায়নে, সেটাই কী তবে হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত গভীর সমুদ্রবন্দর? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ মিটার বা ৫৯ ফুট গভীরতা সবচেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার জন্য যথেষ্ট।
একদিকে আগামী জানুয়ারিতে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে, অন্যদিকে চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টিও সরকার এখনো বাতিল করে দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে প্রত্যাশিত সমঝোতা স্মারক সই না হওয়ার পর চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম মন্তব্য করেছে যে সইয়ের কাজটি না হলেও দুই পক্ষই এ ব্যাপারে আরও আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সেদিন চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যেও বোঝা গেল যে সোনাদিয়ার ব্যাপারে চীন এখনো হাল ছাড়েনি।
সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কিছু গভীর প্রশ্ন উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অধীনে সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে, যা আসলে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আনার কাজেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। জাইকার সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। তারা বলছে, এই বন্দর ‘ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্যিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে।’ তাহলে এটাই হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। অন্যদিকে এর মাত্র ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দরকে (সোনাদিয়া) বাস্তবসম্মত মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তার মানে, সরকার এখনো বিষয়টি পরিষ্কার না করলেও শেষ পর্যন্ত কি সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাতিল হয়ে যাচ্ছে? মাতারবাড়ীকে সোনাদিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারণের চিন্তাভাবনাই বা কতটুকু বাস্তবসম্মত?
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সঙ্গে সে অঞ্চলের ওপর একটি অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক রয়েছে। ব্লুমবার্গ নিউজের প্রতিবেদন বলছে, বঙ্গোপসাগর কৌশলগতভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ যে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতেও পিছপা হবে না জাপান, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো। জাপানি বিনিয়োগে এ অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে চীনের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এই দক্ষিণ এশিয়া দিয়েই চীনের ৮০ শতাংশ তেল আমদানি হয়, ফলে চীন এ অঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অতিথি অধ্যাপক ডেভিড ব্রুস্টারের মতে, বঙ্গোপসাগর হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরের ‘যমজ’। এখানকার বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এ নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে, এটাই স্বাভাবিক।
বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর এই ‘কাড়কাড়ি’ অবস্থার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়। এটা পরিষ্কার যে এসব নানা বিবেচনা থেকেই সোনাদিয়া নিয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেনি বাংলাদেশ আর মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে জাপানের পয়সায়। সোনাদিয়া প্রকল্প বাদ গেলে থাকবে পায়রা বন্দর। এটাই কি এখন চীনের শেষ ভরসা?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]