দোষ দেব কাকে?

বাঘ যত হিংস্র প্রাণীই হোক না কেন, খিদে না পেলে শিকার করে না। খাওয়ার তাগিদ না থাকলে জলের সন্ত্রাসী কুমিরও অলস পড়ে থাকে। মানুষ মানবতার ধারক ও বাহক, কিন্তু সে তার নিজের শিশু সন্তানকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। গাছপালার গুষ্টিনাশ করে জায়গাজমি বাড়িয়ে আকাশছোঁয়া দালানকোঠা গড়ে আমরা নিত্যনতুন মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটাচ্ছি। উৎকর্ষের সোপান বেয়ে মহাকাশে গিয়ে বুক চিতিয়ে বলছি, ‘প্রাণীকুলে আমরাই সেরা!’
অথচ মানুষ হিসেবে এখনো আমরা প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলে বাস করছি। আচরণে রয়ে গেছি বাঘ-ভালুকের চেয়ে হিংস্র। প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও ঔপন্যাসিক স্যার উইলিয়াম গোল্ডিং বলেছেন, মানুষের আদিমতা ও হিংস্রতা সহজাত। সে রকম বুনো পরিবেশে গেলে মানুষ তার সভ্যতার লেবাস খুলে হিংস্র হয়ে ওঠে। নোবেলজয়ী এই লেখক তাঁর ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন বুনো পরিবেশে গেলে মানুষ কীভাবে দলাদলি, সহিংসতা আর শক্তি প্রদর্শনে মেতে ওঠে।
সম্প্রতি দেশে একের পর এক যেভাবে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, এতে আর জঙ্গলের প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক পরিবেশেই মানুষ অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটাচ্ছে। চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার তারাপুর গ্রামের কামারবাড়িতে কবিরাজি চিকিৎসার নামে বাবা এমরান হোসেন ও মা আমেনা বেগমের বেদম পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেছেন তাঁর শিশু সন্তান সুমাইয়াকে । কী করেছিল সুমাইয়া? ওকে ‘জিনে ধরেছে’। এই ‘জিন তাড়ানোর’ পিটুনি খেয়েই রক্তক্ষরণে মারা গেছে মেয়েটি। গণপিটুনির পর বাবা-মা যদিও কারাগারে, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।
এর আগের দিন সোমবার বিকেলে খুলনার টুটপাড়ার এক মোটর গ্যারেজে ঘটে যায় আরেকটি পৈশাচিক ঘটনা। এই ঘটনার বলি রাকিব (১৩) নামের এক শিশু। কমপ্রেসর মেশিনের মাধ্যমে তার মলদ্বার দিয়ে বাতাস ঢোকানো হলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। একপর্যায়ে মুত্যুই হয় তার নিয়তি। কী করেছিল সে। ওই গ্যারেজের কাজ ছেড়ে দিয়ে আরেকটি গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল। দোষ বলতে এটুকুই!
এর কয়েক দিন আগে সিলেটে অমানুষিক নির্যাতনে মারা যায় শিশু রাজন। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ভিত্তিহীন চুরির অভিযোগ। শিশুদের ওপর এমন সব নির্যাতনের ঘটনা ঘরে-বাইরে অহরহ ঘটছে। ঝরে যাচ্ছে কচি প্রাণ। কোনো প্রতিকার নেই। সামাজিক কোনো প্রতিরোধ নেই।
গ্রেপ্তার হয়, মামলা হয়, দিনের পর দিন ঝুলে থাকে তা। এর মধ্যেই ঘটে চলে শিশুকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা, শিশুকে মেরে লাশ সুটকেসে ভরে ফেলে দেওয়া, ফুঁসলে নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো। আমাদের বুক ভরা যত ক্ষোভ, মনের যত আক্রোশ—সব যেন শিশুদের জন্য। আবার আমরাই বলি—এই শিশুরাই একদিন গড়বে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু কী ভবিষ্যৎ তারা উপহার দেবে?
একটি শিশু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার সামাজিকীকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজনের সাহচর্য ও পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুরা যা দেখে, যা শোনে, যা উপলব্ধি করে, সেটাই মনের নোটবুকে টুকে রাখে। স্মৃতি লালন করে এসব ঘটনা। অস্থিরতা, সহিংসতা, নির্মমতার স্মৃতি কখনো শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ ঘটতে দেবে না। বড় হতে হতে এসব বিচ্যুত আচরণ তার মধ্যেও ঢুকে যাবে রক্তবীজের মতো। এর বহিঃপ্রকাশও ঘটবে নানা রকম অঘটন ও অপরাধের মাধ্যমে।
খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জঙ্গিবাদের দৌরাত্ম্যে ভরা আফগানিস্তানই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯৭৯ সাল থেকে প্রায় এক দশক ধরে রুশ আগ্রাসনে সে দেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ওই সময় যুদ্ধ ও হানাহানির কারণে আফগানিস্তানের ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন হামলা ও সহিংসতায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষক মারা গেছেন। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। সোভিয়েত আগ্রাসন শেষ হওয়ার পর তালেবান আমলেও সহিংসতা ছাড়া কিছুই দেখেনি আফগান শিশুরা। এখনো তাই দেখছে। ন্যাটো ও আফগান সেনার সঙ্গে জঙ্গিদের লড়াই আফগানিস্তানে এখন ডালভাতের মতো ঘটনা। সে দেশের শিশুরাও এ পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত। এ জন্য শিশুরা খেলার সময় একদল খেলনা বন্দুক নিয়ে জঙ্গি সাজে, আরেক দল সেনা। ব্যস, এভাবে চলে তাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এভাবে খেলতে খেলতেই এসব শিশু বড় হয়ে যদি সত্যিকারের অস্ত্র হাতে রক্ত ঝরাতে শুরু করে, কে ঠেকাবে তাদের?
গত সোমবার এএফপির খবরে জানানো হয়, ইরাকে কেবল আনবার প্রদেশেই দেড় হাজারের বেশি স্কুল হয় ক্ষতিগ্রস্ত, নয় তো ধ্বংস হয়েছে। ২০১৪ সালের শুরু থেকে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের হামলা ও অভিযান এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। স্কুলই যদি না থাকে, তাহলে শিশুরা পড়বে কোথায়?
আর পড়াশোনা না করতে পারলে শিশুদের ভবিষ্যৎ তো অবধারিতভাবে অন্ধকার।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমাদের শিশুরা যুদ্ধ দেখছে না, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞও দেখছে না, দেখছে চারপাশের হিংস্রতা। সুখেদুঃখে যে বড়রা তাদের পরম নির্ভরতার আশ্রয়, তার মধ্যেই বিধ্বংসী দানবের বাস। এই দানবের প্রভাবে ওরাও যদি ভবিষ্যতে দানবের শাখা বিস্তার করে, দোষ দেব কাকে?