হরতালের আগের মধ্যরাতের বিচিত্র চিন্তা

সামনে আমার নিস্তরঙ্গ অখণ্ড সময়,
যে সময় কাটে না, নিস্তরঙ্গ দীঘির মতো।
যেখানে কাটা যায় না সাঁতার,
সেখানে পড়ে আছে এক অর্গলহীন কারাগারে।
কথা বলতে ইচ্ছে করে না, হাঁটতেও না।
প্রেমহীন এক অনিশ্চিত লোকালয়ে।
লোকালয়ে এখন মধ্যরাত্রির শেষ
ভোরের আলো ফুটবে কখন জানি না
সেও অনিশ্চিত।
মানুষে মানুষে কি গিজগিজ করবে রাজপথ?
নাকি একটু পরে পরে শুনব অ্যাম্বুলেন্সের একটানা ডাক,
মুমূর্ষু মানুষকে নিয়ে ধাবমান হাসপাতালে,
ফুটবে বোমা-ককটেল
বিমগ্ন মানুষ ছুটবে এদিক-ওদিক প্রাণভয়ে—
শিশুরা খেলনা ফেলে দিয়ে নিষ্ফল ক্রন্দনে দাপাদাপি করবে গৃহে।
হরতালের আগের রাত। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মাথায় ঘুরছে রাতের স্মৃতি। সংবাদ একটানা, টক শোতে আলাপ। একটি ফোনের অপেক্ষায় যখন ১৬ কোটি মানুষ। কিন্তু দুয়ার খুলল না। কথা হলো কিন্তু কাজ হলো না। হরতাল থেকেই গেল। আলোচনাও অনিশ্চিতে এক কানাগলিতেই পড়ে রইল।
এখনো মাথায় আছে সেই জ্বলজ্বলে স্মৃতি হরতালের। হরতাল শেষে একটা স্বপ্ন হাতছানি দিত। সেই স্বপ্নটা একটা নতুন যুগের। মানুষ থেমে থাকে না। এগিয়ে যায়, দিনে, মাসে, বছরে। শিশু-কিশোর হয়, কিশোর থেকে যুবক, তারপর প্রৌঢ়ত্বে এসে বিশ্ববীক্ষা পেয়ে যায়। কিন্তু একটানা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে আছে সেই মানুষগুলো, যাদের জন্ম হয়েছে স্বপ্নভঙ্গের পরে। ৬০ ঘণ্টা হরতালের আগে এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তাইবা এল কেন? এমনি ৭২, ৬০, ২৪, ১২ অথবা লাগাতার অনেক দেখেছি, সহ্য করেছি। কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না কেন?
পৃথিবীর বয়স বাড়ছে, জ্ঞানী হচ্ছে পৃথিবী। সেই সঙ্গে জ্ঞানের তীব্র প্রতিযোগিতায় নামছে মানুষ। কিন্তু কোনো রাষ্ট্র যদি সেই জ্ঞানকে ধারণ না করে গ্লোবটাকে গায়ের জোরে উল্টো দিকে নিতে চায়, তাহলে মানুষের কী হবে? বর্তমান পৃথিবী তো জমিজমার মালিকের নয়, এমনকি কারখানার মালিকের নয়, তথ্যের আর জ্ঞানের সমৃদ্ধিই তার বড় সম্পদ। একটি সিদ্ধান্তের জন্য বছরের পর বছর বসে থাকার সময় নেই। কয়েক মিনিটেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এসে যাচ্ছে। তথাকথিত উন্নত পৃথিবী সেসব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে প্রাচীন ভাবনার পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রকে। একদা জ্ঞান-বিজ্ঞানসমৃদ্ধ গ্রিস আজ দরিদ্র। নতুন ভাবনাকে সে গ্রহণ করতে পারছে না। অন্যদিকে চীন এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। কিন্তু দেশ ভাগ হয়ে গেছে দুই ভাগে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাষ্ট্র, যেখানে অসাম্প্রদায়িকতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনভাবনা থাকার কথা; অন্যদিকে নিছক বিরোধিতা এবং ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা। দুটি ভাগেই রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। দুটি দলই জাতীয়তাবাদের দাবিদার। প্রথম দলটি জাতি-রাষ্ট্রের কথা বলছে, দ্বিতীয়টি ধর্ম-রাষ্ট্রের ধ্বজাটি ধরে আছে।
১৯৯৬ সালে প্রথম দলটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছে আর দ্বিতীয় দলটি আজকে ২০১৩ সালে একই আন্দোলন করছে। কারণ, অবিশ্বাস। রাজনীতিতে অবিশ্বাস থাকবেই। কিন্তু এই অবিশ্বাসকে অতিক্রম করার কোনো বুদ্ধিদীপ্ত পথ বের না করে পুরোনো পথেই হাঁটতে হবে?
১৭ বছর আগেও কেউ কেউ নির্দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিল। কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা বলেনি। একমাত্র নির্বাচন কমিশনই সব দেশে এই সমস্যার সমাধান। ভারত প্রথম থেকেই একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন করে ফেলেছিল, যার জবাবদিহি রাষ্ট্রপতি ও সংসদের কাছে। যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রেও তাই। কিন্তু পাকিস্তান তা করতে পারেনি। একমাত্র ১৯৭০ সালের নির্বাচন একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু তার চেয়েও শক্তিশালী যে ছিল সেনাবাহিনী। আজও তাই।
বাংলাদেশেও ১৯৭৫ সালের পর সেনাবাহিনী একটি শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচনও পরিচালিত হয়। সে সময়গুলোতে হাইকোর্টের বিচারপতিদেরও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনায় তাঁদের ভূমিকাও বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তাই নির্বাচন কমিশন একটা অবিশ্বাসের উপাদান। সব রাজনৈতিক দল মিলেই উচিত ছিল নিজস্ব স্বার্থের ঊর্ধ্বে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। দুই দলের পারস্পরিক অবিশ্বাসের ফলে সবকিছুই বিতর্কিত হয়ে পড়ছে।
যা হোক, আমাদের সন্তানদের কী হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতর্ক, এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত। এত বড় ধরনের অনুপ্রেরণার জায়গা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের আন্দোলন এবং বল্গাহীন আচরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন ও উপাচার্য নিয়োগে যখন থেকে নির্বাচনপদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়েছে, তখন থেকেই শিক্ষকেরা বিভক্ত এবং সুস্পষ্টভাবে নিজের দলের লোকটিই নিয়োগ পেয়ে থাকেন। নির্বাচন না করেই উপাচার্য নিয়োগ পান। কিন্তু নির্বাচন হলেই লাভ কী? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো নির্বাচিত। নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থায় অভিভাবকেরা বিপর্যস্ত। শিক্ষা পণ্যে পরিণত বেসরকারি ব্যবস্থায়। কিন্তু এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তারা তো আর শিক্ষকতায় কিংবা প্রশাসনে আসছে না। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র ভরসার স্থল। সভা-সমাবেশে তো বটেই, সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বল্গাহীন বক্তব্য ও আচরণের প্রভাব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে একেবারে পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পারিবারিক জীবনের অস্থিরতাও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ ব্যাপারে অবশ্য টেলিভিশন মিডিয়াই বেশি দায়ী। টেলিভিশন সিরিয়ালে যে অস্থির জীবন ও সংস্কৃতির প্রচার হচ্ছে, তাও ভয়াবহ। ভারতীয় চ্যানেলগুলো পারিবারিক সংকট সৃষ্টিতে এক পা এগিয়ে। এর মধ্যে হরতাল।
একদা হরতাল ছিল পরাধীনতার নিগড় থেকে মুক্তির অন্যতম অস্ত্র। সেই অস্ত্র এখন নিজেদের বিরুদ্ধেই ব্যবহূত হচ্ছে। হরতালের এখন পূর্বশর্তই হচ্ছে সন্ত্রাস। হরতালের কারণে সুদূর পঞ্চগড়ের বা টেকনাফের কোনো মুমূর্ষু রোগীর উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার উপায় নেই।
রাজনীতি কি সৃজনশীল হতে পারে না? দরিদ্র দেশের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ও প্রাত্যহিক ব্যয়ের বিনিময়ে সংসদটিতে কি গঠনমূলক আলোচনার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে না?
প্রধানমন্ত্রী ফোনে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে হরতাল প্রত্যাহার এবং আলোচনার আহ্বান করেছেন। বিলম্বে হলেও নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। আশা করি, বিরোধীদলীয় নেতাও ইতিবাচক সাড়া দেবেন। বরফ গলবে।
আলোচনা করে নিষ্পত্তি করা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গণতন্ত্রের কথা বলবেন আর আলোচনার টেবিলে বসবেন না, তা হয় না। জনমনে একটা বিষয় দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যা বিরোধী দলের জন্য ভালো নয়। হরতালে নাশকতা করে থাকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। তারা অতিমাত্রায় সক্রিয়। মানুষ ভাবছে সমঝোতার অন্তরায় ওই দলটি, কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে তারা মরিয়া হয়ে উঠছে।
বিরোধীদলীয় নেতা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনকার বিরোধী দল তাঁকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেনি, এ কথা সত্য। কিন্তু তাই বলে আজকের দিনেও একই কাজ করতে হবে? এর ব্যত্যয় কি হতে পারে না? শনিবার রাতে দুই নেত্রী টেলিফোনে আলাপ করার পর জাতি হঠাৎ আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিলে কিন্তু তার পরই আঁধার নেমে এসেছে। নানা সন্দেহে রাত কেটেছে মানুষের।
আমরা কী চাই? শিশু খেলতে খেলতে পড়তে যাবে। দুরন্ত কিশোর জানবে লেখাপড়া আসলে দেশসেবার জন্য। তাই মানুষ হতে হবে। যৌবনদৃপ্ত মানুষের সামনে শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ। কবি স্বপ্ন দেখাবে। গায়ক মানুষের গান গাইবে। চিত্রকর এক সোনালি ভবিষ্যতের ছবি আঁকবে। তীব্র দূষণে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ নিজেই নির্মল করবে পৃথিবীকে। কৃষক-শ্রমিক উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। রাজনীতিবিদদের কণ্ঠে উচ্চারিত হবে শান্তি ও সমৃদ্ধির কথা। রাজনীতিবিদ আর জনগণের স্বপ্ন কবে থেকে অভিন্ন হবে?
এই অনিশ্চিত লোকালয়ে উটের পিঠে স্বদেশ আর কত হাঁটবে?
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।