বন্দরনগরে এখন আর বাণিজ্যে লক্ষ্মী বসত করে না

গত শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ীকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘ভালো নেই।’ কেন ভালো নেই—জানতে চাইলে প্রথমেই তিনি অভিযোগ করলেন, জাতীয় সংবাদপত্রে দুর্ঘটনা ছাড়া চট্টগ্রামের খবর শিরোনাম হয় না। তাঁদের অভাব অভিযোগের কথা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয় না। জিজ্ঞেস করি, সত্যিই কি হয় না?
তিনি বললেন, ‘হলেও ঢাকার খবরের নিচে হারিয়ে যায়।’
বন্দরনগরের ব্যবসা–বাণিজ্যের সমস্যা প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, চট্টগ্রামে যে হারে লোকসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে শহর বাড়ছে না। অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে না। বিমানবন্দর থেকে শহরে আসতে কখনো কখনো তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। বিমানবন্দরের সড়ক আর বন্দরের সড়ক এক হওয়ায় নিত্য যানজট লেগে থাকে। রাস্তার ওপর বড় বড় ট্রাক–কনটেইনার দাঁড়িয়ে থাকায় সড়ক আরও সরু হয়ে পড়েছে। একজন বিদেশি বিমানবন্দর থেকে নেমে যদি এ অবস্থা দেখেন, তিনি কেন বিনিয়োগ করবেন?
আর কী সমস্যা?
তিনি তালিকা দীর্ঘ করতে থাকেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যার কারণে চট্টগ্রামে অনেক নতুন কারখানা চালু হতে পারছে না। পুরোনোগুলোও বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে সময়ে সময়ে বন্ধ রাখতে হয়। গত বছর সমস্যাটি অারও প্রকট ছিল। কারখানায় নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হলে ঢাকা বা তার আশপাশের এলাকা অগ্রাধিকার পায়। চট্টগ্রামে ৭০০ তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। এর মধ্যে অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ৪০০ চালু থাকার কথা বলা হলেও আসলে ঠিকমতো চলছে ২৮০টি। ব্যাংকঋণ, রপ্তানির কাগজপত্র ঠিক করতে কিংবা নতুন কারখানায় বিদ্যুৎ-সংযোগ নেওয়ার জন্য ঢাকায়ই দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। চট্টগ্রামে এখন
জমির দাম ঢাকার চেয়েও বেশি। সরকার ইপিজেডের জন্য পানির দামে জমি দিলেও নতুন উদ্যোক্তাদের জমি দিচ্ছে না। ফলে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো নয়। এসব কারণেই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও ঢাকায় চলে যাচ্ছেন।
ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, চট্টগ্রামের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি উদাহরণ হলো সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর। বহু বছর ধরে আলোচনা চলে আসছিল। এখন বলা হচ্ছে সেটি পটুয়াখালীর পায়রায় নিয়ে যাওয়া হবে। সোনাদিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মিয়ানমার, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য আনা-নেওয়ায় অনেক বেশি সুবিধা হতো। খরচ কম পড়ত।
২.
পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলোকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করা হয়। যেমন ভারতের মুম্বাই ও পাকিস্তানের করাচি। বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করার উদ্দেশ্য হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত সবকিছু সেখানেই সমাধান হবে। অনেকটা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মতো। বাংলাদেশে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল দুই দশক আগে। স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল সেখান থেকেই ব্যবসায়ীরা সব ধরনের সেবা পাবেন। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। দেশি–বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর আগে চট্টগ্রামে ছিল, এখন তারা ঢাকায় নিয়ে গেছে। সরকারি সংস্থার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁদের ঢাকায় আসতে হয়। এমনকি বিদেশি ক্রেতারাও এখন চট্টগ্রামে যান না। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকায় আসতে হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের।

>চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন-অগ্রগতি আশা করা যায় না। এখনো দেশের আমদানি পণ্যের ৮০ শতাংশ আসে এবং রপ্তানি পণ্যের ৭৫ শতাংশ যায় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে

কেন তাঁরা চট্টগ্রামে যান না? জানতে চাইলে বিজিএমইএর এক শীর্ষ নেতা জানান, সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক থাকে। তাঁরা ঢাকা-চট্টগ্রাম করবেন কেন? তার চেয়ে ঢাকায় যাঁদের পাবেন, তাঁদের সঙ্গেই তো ব্যবসা করবেন। তা ছাড়া, বিদেশি ক্রেতাদের সরাসরি চট্টগ্রামে আসার উপায় নেই। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর নামে আন্তর্জাতিক দেওয়া হলেও এখনো এটি ‘মফস্বলীয়’। কেবল প্রবাসী শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কয়েকটি ফ্লাইট চলাচল করে। ব্যবসায়ীরা আসেন সিঙ্গাপুর, লন্ডন, প্যারিস বা নিউইয়র্ক থেকে। সেসব জায়গার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি ফ্লাইট নেই। আমদানির কাগজপত্র বন্দরে ঠিকঠাক করা গেলেও রপ্তানির জন্য ঢাকায় বিভিন্ন সংস্থার কাছে আসতে হয়। তাহলে বাণিজ্যিক রাজধানীর অর্থ কী?
আলোচনাকালে তরুণ প্রজন্মের এক ব্যবসায়ী বললেন, আমরা ঠিক বাণিজ্যিক রাজধানীর অর্থ খুঁজে পাই না রাজনৈতিক স্লোগান ছাড়া। প্রথমে খালেদা জিয়া চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন। এরপর কত সরকার গেল। কোনো কাজ হলো না। সবশেষে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজের হাতে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু সমস্যার সমাধান কী? তাঁর জবাব, সমাধান একটাই। সরকারের নীতি পরিবর্তন করতে হবে। সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রায়িত করলে হবে না।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পেরেছি যে, বন্দরনগের সংকট ও সম্ভাবনা—দুই আছে। কথা হলো, আমরা সেই সংকট কাটিয়ে সম্ভাবনার দরজা প্রসারিত করতে চাই কি না? চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন-অগ্রগতি আশা করা যায় না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের আমদানি পণ্যের ৮০ শতাংশ আসে এবং রপ্তানি পণ্যের ৭৫ শতাংশ যায় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। জিডিপিতে চট্টগ্রামের অবদান ১২ শতাংশ। আর মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশও আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই চট্টগ্রাম শহর ও বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। আঞ্চলিক জোট সার্ক ও আসিয়ানের সংযোগকেন্দ্র হতে পারে চট্টগ্রাম। অধিকন্তু ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হলে এই নগর হবে এ অঞ্চলে প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
অতএব, সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, ঢাকাই বাংলাদেশ নয়। চট্টগ্রামকে সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানীর সব সুযোগ–সুবিধা দিতে হবে। আর ব্যবসা–বািণেজ্য কেবল তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকাও ঠিক হবে না। নতুন নতুন খাত তৈরি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর খালি জায়গা আছে, সেখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা যাবে না। উন্নয়নের সুবিধা তাদেরও দিতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িকে নতুন করে সাজাতে হবে। সবার আগে যে কাজটি করা জরুরি তা হলো যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন করার কাজ চলছে। কিন্তু এটি যখন শেষ হবে, তখন দেখা যাবে আট লেন প্রয়োজন। সড়কের পাশাপাশি নৌ ও রেলপথকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে পণ্য আমদানি–রপ্তানির জন্য এই দুটি পরিবহনই অধিক সাশ্রয়ী।
ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর উপায় কী? এ প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বললেন, প্রশাসন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা যাতে চট্টগ্রামে বসেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটি মোটেই অসম্ভব নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]