গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আমেরিকার ফেডারেল কোর্টের বিচারপতি রবার্ট এইচ জ্যাকসন অভিমত দিয়েছেন, ‘নাগরিকদের ভুল করা থেকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব নয়; বরং নাগরিকদের দায়িত্ব হলো সরকারকে ভুল করা থেকে রক্ষা করা।’ একটি রাষ্ট্রে একই পদে বহু ব্যক্তি বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের কেউ কেউ তাঁদের কাজের স্থায়ী ছাপ রেখে যান, অনেকে দায়িত্ব পালন শেষে বিস্মৃত হন বা হারিয়ে যান। বিচারপতি জ্যাকসন আমেরিকার বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক নক্ষত্র।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিচারপতি জ্যাকসনের আইনের কোনো স্নাতক ডিগ্রি ছিল না। ছাত্রজীবনে কিছুদিন তিনি আইন পড়েছিলেন মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি বিচার বিভাগের সবগুলো প্রধান পদ অলংকৃত করেন। ফেডারেল কোর্টের শীর্ষ বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সলিসিটর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। নুরেমবার্গ আদালতে তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের চিফ প্রসিকিউটর।
বিচারপতি জ্যাকসন এমন কিছু কিছু দুঃসাহসী রায় দিয়েছেন, যা শুধু সরকারের বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে গেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা একটি রায়ের কথা উল্লেখ করতে পারি। বিখ্যাত মামলাটি হলো ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া স্টেট বোর্ড অব এডুকেশন বনাম বার্নেট।’ ওই রাজ্যের স্কুলগুলোতে বিধিবদ্ধ নিয়ম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকাকে শিক্ষার্থীরা কপালে হাত তুলে অভিবাদন জানানোর। জেহোভা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের এক শিক্ষার্থী জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়।
সে মামলা শেষ পর্যন্ত ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে যায়। বিচারপতি জ্যাকসন শিক্ষার্থীর পক্ষে রায় দেন। রায়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের তৈরি আইনের চেয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা বা ইনডিভিজুয়্যাল লিবার্টি বড়। ওই সম্প্রদায়ের মানুষ কোনো কিছুকেই সালাম করে না, সুতরাং তাকে দিয়ে জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানাতে বাধ্য করা যাবে না। ওই রায় দেওয়ার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর ‘ফ্রি স্পিচ ক্লজ’ বা বাক্স্বাধীনতার ধারাটির দোহাই দেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও ঘোষণা করা হয়েছে: ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ [৭(২) ধারা] বাংলাদেশের সংবিধান জনগণকে ‘সকল ক্ষমতার মালিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে মালিকানাটি জনগণের কাছে আছে কি না, সে প্রশ্ন করার অধিকার জনগণের কতটা আছে, তা তারা জানে না। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় হেভিয়াস কর্পাস মামলায় প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞদের এ সম্পর্কে মতামতও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য সব আইনগুলো সংবিধানের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হয়। সংবিধান সর্বোচ্চ আইন কারণ সে বিদ্যমান, সে বিদ্যমান কারণ তাতে জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত।’ (২৫ ঢাকা ল রিপোর্টস, পৃ. ৩৩৫)
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আমাদের সংবিধান খুব স্পষ্টভাবেই প্রত্যেক নাগরিককে দিয়েছে। তবে একই সঙ্গে ‘...জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ-সাপেক্ষে’র কথাও লেখা আছে [৩৯(২) ধারা]। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা যে বলা হয়েছে তা দুটি আলাদা শব্দ হলেও তার মর্মার্থ এক। অবাধ অর্থাৎ যা খুশি তা-ই চিন্তা করে তা প্রকাশের স্বাধীনতা নয়, বিবেকসম্মত চিন্তার স্বাধীনতার কথাই বলা হয়েছে। বিবেকসম্মত চিন্তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। বিবেকসম্মত চিন্তার সংজ্ঞা হচ্ছে সর্বসম্মতভাবে মানুষ যে কাজটি ‘ভালো’ এবং যে কাজটি ‘মন্দ’ বলে মনে করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হলো সেখানে মত প্রকাশের অধিকার থাকবে এবং স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের অধিকার সুনিশ্চিত। কোনো মতামতে কারও ব্যক্তিগত অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। তিনি সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। কিন্তু কারও মনে আঘাত লাগবে বলেই সে সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে বা লিখতে পারবে না, তা আমাদের বা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানই বলে না। বাংলাদেশে প্রায়ই কোনো নেতা বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে কটাক্ষ বা সমালোচনা করার দায়ে মানহানির মামলা হয়ে থাকে। তাতে অভিযুক্তের হয়রানির শেষ নেই। দিনের পর দিন আদালতে ঘুরতে হয়। একপর্যায়ে গিয়ে একটা মীমাংসা হয় বটে, কিন্তু বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষেরই অর্থ ও শ্রমের অপচয় হয়।
পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তির স্বাধীনতা বিষয়টি খুবই সুরক্ষিত। বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও সর্বোচ্চ। কিন্তু উপমহাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষেই অসহিষ্ণুতা অতি বেশি, যা আদালতে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। ষাটের দশকে মুম্বাইয়ের একজন খ্যাতিমান কলাম লেখিকা ছিলেন প্যাট শার্প। বেঙ্গলি-তে প্রকাশিত তাঁর একটি কলামে তিনি একটি আপত্তিকর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেন। তাঁর সেই মন্তব্য যেকোনো বাঙালির গায়ে না লেগে পারে না। তিনি লিখেছিলেন: ‘...[বাঙালিদের] আর মাত্র একজন বীর (?) সুভাষচন্দ্র বসু, একজন দেশদ্রোহী, যিনি জাপানের পক্ষে একজন মীরজাফর ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে শহীদের সম্মান দেওয়া হয় প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুদিবসে।’
নেতাজির পরিবার এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। শরৎচন্দ্র বসুর ছেলে শিশির বসু কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে প্যাট শার্পের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেন। প্যাটের সাজা হয়। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ আপিলটি খারিজ করে দিয়ে রায়ে মন্তব্য করেন: ‘আইনের দৃষ্টিতে সুভাষচন্দ্রের ভাইপো একজন বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং মামলাটি মৃত ব্যক্তির সম্মানহানির জন্য দায়ের করা হলেও তা আইনে অচল নয়। দেশবাসী সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ করে কারণ তিনি তাদের একজন অতি প্রিয় নেতা। তাঁকে দেশদ্রোহী বা মীরজাফর আখ্যায়িত করে আপিল আবেদনকারী নিজেকেই অপমানিত করেছেন।’
ওই আপিল মামলার রায়ে যা বলা হয়েছিল তার মর্মার্থ হলো, ভাব ও মতামত প্রকাশেও সংযম দরকার। কিন্তু তাই বলে মত প্রকাশে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় রাষ্ট্র বাধা দিতে পারে না।
গত জানুয়ারিতে আমি ভারতে গিয়েছিলাম গান্ধী পিস মিশনের আমন্ত্রণে এক আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে ভারত ও বিভিন্ন দেশের গান্ধীবাদী ও একাডেমিশিয়ানরা আলোচনায় অংশ নেন ও প্রবন্ধ পড়েন। তাঁদের একজন ছিলেন সিকিম হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি আগে কলকাতা হাইকোর্টেরও বিচারপতি ছিলেন, বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত। তিনি একজন গান্ধীবাদী। সম্মেলনের ফাঁকে কী এক প্রসঙ্গে আদালত অবমাননা নিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রথম যেদিন বেঞ্চে যোগ দিলাম, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আমাকে কনটেম্পট্স অব কোর্টস অ্যাক্ট-এর বইটি দেখিয়ে বললেন, এটি ড্রয়ারেই রেখে দিয়ো, প্রয়োগ করতে যেয়ো না। কনটেম্পট্স মামলার কোর্টে আমিও বিচারক ছিলাম। লম্বা বিচারক জীবনে কাউকে আদালত অবমাননার মামলায় শাস্তি দিইনি।’
১৯২৬ সালের কনটেম্পট্স অব কোর্টস অ্যাক্টের ১২ ধারায় আদালত অবমাননার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে শতাব্দীব্যাপী বহু আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তিও হয়েছে কারও কারও। তবে ভারতের আদালত বিষয়টিকে যথাসম্ভব নমনীয়ভাবেই দেখেন। আদালত অবমাননার মামলাগুলোর রায়ের ভিত্তিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। তার বাংলা অনুবাদ মোটের ওপর এ রকম: ‘বিচারিক কাজে অতি মাত্রায় সংবেদনশীল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। একজন বিচারককে তাঁর নিজের পদটিই এমন প্রশিক্ষণ দেয়, যার কল্যাণে তিনি সেনসিটিভ বা অল্পতেই ক্ষুব্ধ হওয়ার পরিবর্তে সহানুভূতিশীল হন। অন্যদের চেয়ে একজন বিচারক মামলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অহংবোধ, হতাশা, অনুভূতি ও মানসিক চাপ বেশি অনুভব করতে সক্ষম। তবু তার একটা সীমা থাকা বিশেষ প্রয়োজন। একজন বিচারকের প্রতি এমন অপবাদ রটনা করা যায় না, যার ফলে বিচারব্যবস্থা হুমকি কিংবা বিনষ্টের সম্মুখীন হয়। তার অর্থ এই নয় যে বিচারকগণকে রক্ষা করা আবশ্যক। কারণ, বিচারকগণ নিজেদেরকে রক্ষা করতে অসমর্থ নন। তার অর্থ হলো, জনগণের স্বার্থ ও অধিকারের উদ্দেশ্যেই বিচারব্যবস্থাকে ওই অপবাদ রটনা থেকে রক্ষা করতে হবে।’ (দ্রষ্টব্য অল ইন্ডিয়া রিপোর্টস, ১৯৮৩, পৃ. ১১৫১)
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। অন্য দুটি হলো নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা বা সংসদ। একটি ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা-ই, যেখানে তিনটি বিভাগই সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে এবং থাকবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগের বাইরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ রয়েছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা অস্বীকার করে না কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
আমাদের দেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ বিভিন্ন দিক থেকে আসে। কোনো সংবাদ, তা যতই জনস্বার্থের পক্ষে হোক, কারও স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সাংবাদিকদের আসামি করা হয়। সংবাদ বা প্রতিবেদন ভুল বা মিথ্যা হলে তা সংশোধনযোগ্য। প্রতিবাদের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু আজকাল সাংবাদিকদের হয়রানি করতে ফৌজদারি মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। অভিযোগ নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত না করিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে থাকে। সম্পাদক ও সাংবাদিকদের নাকে দড়ি দিয়ে দেশব্যাপী ঘোরানো হয়। অর্থাৎ অভিযোগ প্রমাণের আগেই শাস্তি।
কথায় কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে মামলা, মানহানির মামলা বা আদালত অবমাননার মামলা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাউকে অসম্মান বা অমর্যাদা করাকে সমর্থন করতে পারে না। আদালতের মর্যাদা সমুন্নত রাখা নাগরিকদের কর্তব্য। নির্বাহী ও আইনপ্রণেতাদেরও দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের ও নাগরিক সমাজের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে না দেওয়া। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার যেখানে স্বীকৃত, সেখানে তার অপব্যবহার হতেও পারে। তবু সেই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের কথা স্মরণ করতে পারি: ‘জনগণের ইচ্ছাই যেকোনো সরকারের একমাত্র বৈধ ভিত্তি; আর আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷