হৃৎপিণ্ড ছাড়া এক দেহ

‘২০ বছর মেয়াদি একটি রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করেছি এবং সেখানে ২৩৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। আমাদের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহের মধ্যে আছে দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম,কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া, পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা, ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর এবং খুলনা-মংলা নতুন রেললাইন/পুনর্নির্মাণ, মেহেরপুর জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল সার্ভিস চালু করা, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তরে রেলসেতু নির্মাণ, ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটার গেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ ইত্যাদি। অন্যদিকে, আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে “আখাউড়া-আগরতলা” রেল কানেকটিভিটি স্থাপন করতে যাচ্ছি আমরা।’

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা, ৪ জুন, ২০১৫।
অর্থমন্ত্রীর পুরো পরিকল্পনাটিতে কোথাও কারখানা শব্দটি নেই। ইতিমধ্যে মাস্টারপ্ল্যানের ৩৮ হাজার কোটি টাকা বেশ কিছু প্রকল্পে খরচও হয়েছে—স্টেশনগুলো রি-মডেলিং হওয়া যার অন্যতম। রি-মডেলিং প্রকল্পের একটি স্টেশন আখাউড়া রেলওয়ে জংশন। এই জংশনকে রি-মডেলিং বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। একই সঙ্গে ওই স্টেশনের ইন্টার লকিং সিগন্যালিং ব্যবস্থা প্রবর্তন বাবদ আরও ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থাৎ সাকল্যে ২৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা স্টেশন রি-মডেলিং বাবদ দেওয়া হয়।
এই রি-মডেলিংয়ের টাকা থেকে অনধিক ২ কোটি টাকায় একটি অত্যাধুনিক রেল ইঞ্জিন ক্রয় বা সংগ্রহ করেও অবশিষ্ট টাকা দিয়ে কাঁচামালের জোগান দেওয়াসহ রেলওয়ে কারখানায় ওভারটাইম চালু করে কমপক্ষে ২০টি আন্তনগর ট্রেনের অকেজো শোভন চেয়ারকোচ মেরামত করা যেত। ওই মেরামতকৃত কোচ ও সংগ্রহকৃত ইঞ্জিনের সমন্বয়ে গঠিত আন্তনগর ট্রেনটি ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে চলাচলের ফলে রেলের বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পেত প্রায় ১৪ কোটি ২৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুমিল্লা, লাকসাম, ফেনী ইত্যাদি রেলস্টেশনসহ দেশব্যাপী এ রকম সব স্টেশনে ব্যাপক অর্থ ঢালা হয়েছে।
এই যে নতুন নতুন রুট তৈরি হচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। কিন্তু পুরোনো রুটগুলোকে কি চাহিদামতো বগি ও ওয়াগন সরবরাহ করা সম্ভব হবে? উত্তর, হবে না। তারপর নতুন রুটের জন্য যে ইঞ্জিন, বগিগুলো লাগবে, তা কোথায় পাওয়া যাবে? কথা হচ্ছে, ভারত ও চীনে স্থাপিত কারখানা নামের হৃৎপিণ্ড থেকে এসব আমদানি করে অর্থমন্ত্রী ঘোষিত রেলওয়ের পুনর্জাগরণ সম্ভব কি না?
আমাদের উত্তর আধুনিক শাসকশ্রেণির পরিকল্পকেরা মাস্টারপ্ল্যানের লাখোকোটি টাকা থেকে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা আধুনিকীকরণে মাত্র ১২২ কোটি ২২ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেননি। পাহাড়তলী রেল কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০০৭ সালে জাপানের জেবিআইসি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার মিলে ১৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্বাসন প্রকল্পটির কাজই শুরু হয়নি। এই দুই কারখানার ৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশই ব্রিটিশ যুগের, যা অনেক আগেই উৎপাদনক্ষমতা হারিয়েছে। লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) তৈরির লক্ষ্য সামনে রেখে ১৯৯২ সালের ১৪ মে পার্বতীপুরে ‘কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও ইঞ্জিন তৈরির উদ্যোগ দেশপ্রেমিক কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি!
দুই. ১৯৭০ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলপথকে ঘিরে ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা প্রতিষ্ঠাকালীন শত শত মেশিনের শব্দ ও কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর পদচারণে মুখরিত ছিল। আর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ‘রিকভারি প্রোগ্রাম’-এর আওতায় রেলওয়ের লোকবল ৫৮ হাজার থেকে ৩৫ হাজারে নামিয়ে আনা হয়। বিশেষ করে কমিয়ে আনা হয় কারখানাশ্রমিকদের। যেমন প্রতিষ্ঠাকালীন সৈয়দপুর কারখানায় মঞ্জুর করা পদ ছিল ৪ হাজার, তা ২০০৩ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৬২১ জনে। পার্বতীপুর রেল কারখানায় মঞ্জুর করা পদ ১ হাজার ৬৯৯ জনের বিপরীতে আছে ১ হাজার ৩৬ জন আর পাহাড়তলীতে ২ হাজার ১২৮ জনের বিপরীতে আছে ১ হাজার ২৩৩ জন। অর্থাৎ সব কারখানাই ৪০ ভাগ কম লোকবল নিয়ে চলছে। শুধু লোকবলের ঘাটতির কারণেই ইঞ্জিন, ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামতের সুযোগ থাকলেও অতিরিক্ত

>রেল কারখানাগুলোকে আধুনিক ও উৎপাদনক্ষম না করা গেলে রেলপথ ও স্টেশনগুলো নিথর হয়ে পড়ে থাকবে

টাকা খরচ করেও বাইরে থেকে মেরামত ও আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ কাজের অভাবে মানুষ সাগর পাড়ি দিচ্ছে। অন্যদিকে, যাঁরা কর্মরত আছেন, তাঁদের মধ্যে সৈয়দপুর কারখানার কর্মচারীদের ৭০ শতাংশ ও শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বয়স ৫০-এর ঊর্ধ্বে। পাহাড়তলী কারখানায় কর্মচারী ও শ্রমিকদের ৪৫ শতাংশের বয়স ৫০-এর ঊর্ধ্বে।
তিন. আমরা ব্রিটিশদের তৈরি ৩০০ কিলোমিটার রেলপথ ও ১৫০ স্টেশনও উচ্ছেদ করেছি স্বাধীনতার পর এত বছরে! আর বাকি স্টেশনগুলো স্বাধীনতার চেতনায় তৈরি করেছি বাংলাদেশি মডেলে। ১ হাজার ২০০ একর জমির ওপর ১৯৮৭ সালে পাঞ্জাব রাজ্যের কাবুর থালায় যে রেলওয়ে কারখানা ভারত সরকার স্থাপন করে, তা প্রতিবছর ১ হাজার ৫০০ কোচ উৎপাদন করে, যেগুলো ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। অথচ ১৮৭০ সালে ১১০ একর ভূমির ওপর সৈয়দপুর রেল কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলেও আধুনিকায়ন হয়নি। উল্টো যা যন্ত্রপাতি আছে, তা অব্যবহারে ধ্বংসের মুখে।
ইতিমধ্যে খরচ হয়ে যাওয়া ৩৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কারখানা তিনটিতে ১ হাজার কোটি করে মোট ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা গেলে, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় জনবল, কাঁচামাল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে বিপুলসংখ্যক ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করে গ্রামের পর গ্রামে বিদ্যুতের তার-খুঁটি লাগিয়ে যেমন লাভ নেই, তেমনি রেল কারখানাগুলোকে আধুনিক ও উৎপাদনক্ষম না করা গেলে রেলপথ ও স্টেশনগুলো নিথর হয়ে পড়ে থাকবে। কারখানা নামের হৃৎপিণ্ড না থাকলে রেললাইন নামের শিরা-উপশিরা লইয়া জাতি কী করিবে! যতই রেল পুনর্জাগরণের কথা বলা হোক, হবে না! হবে না!
নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।