সরকারের আয় বাড়াতে হবে

>গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল অনুমোদিত হয়েছে। এতে গ্রেড ভেদে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মূল বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বেড়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রকাশ করা হলো।
কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

২০০৯ সালের পর সরকার ২০১৫ সালে আবার পে-স্কেল দিল, বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে এটার যৌক্তিকতা বা যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এটা খুব জরুরি ছিল। এর ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয় বাড়বে। কিন্তু বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো না হলে ব্যাপারটা সমতামুখী হবে না। অনেকেই যুক্তি দেন, বেসরকারি খাতের বেতন এমনিতেই অনেক বেশি। কিন্তু কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। বেসরকারি খাতে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন অনেক বেশি হলেও মধ্যম ও নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন অনেকটা সরকারি চাকরিজীবীদের মতোই। আবার তাঁদের পেনশনও নেই।
আবার সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড রয়েছে, এটা অনেক বেশি। গ্রেড কমানো দরকার। আগে ২০ নম্বর গ্রেডের মূল বেতন ছিল ৪ হাজার ১০০ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৫০ টাকা। আবার ১ নম্বর গ্রেডের মূল বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকা, সেটা এখন দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ বেতন বৃদ্ধির আনুপাতিক হার একই হলেও টাকার অঙ্কে পার্থক্য অনেক। এই পার্থক্য কমানো উচিত। বেসরকারি খাতের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। সরকার তো তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু একটা আদর্শ মানদণ্ড নির্ধারণ করতে পারে। সরকার শ্রেণি উঠিয়ে দিলেও গ্রেড তো থাকছে। কে কোন গ্রেডে চাকরি করেন, সে বিষয়ে লোকে কথা বলবেন।
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ভিত্তিতে সরকারের সূচক তৈরি করা উচিত। এতে সবাই বুঝতে পারবেন, ব্যয় কতটা বাড়ল। এতে বেসরকারি খাতও বুঝতে পারবে, কর্মীদের জীবনযাপনের ব্যয় কতটা বেড়েছে। তখন সেই সূচক অনুসারে তারা কর্মীদের বেতন বাড়াতে পারে। পে-স্কেল বাস্তবায়নের পর আমরা প্রত্যাশা করব, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও কর্মদক্ষতা বাড়বে। তবে বেতন বাড়লেই দুর্নীতি কমে যাবে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের সংস্কার করা উচিত। মানুষ যদি প্রশাসনের কাছ থেকে ভালো সেবা না পায়, তাহলে এই পে-স্কেল জনকল্যাণমুখী নয়।
আবার এই অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সরকারের ওপর চাপ পড়বে। কথা হচ্ছে, আয় বেশি থাকলে বেশি ব্যয় করাই যায়। কিন্তু রাজস্ব আয়ের হার আশানুরূপ না হওয়ায় সরকারের ওপর চাপ পড়বেই। আবার হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রশাসনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ আছে। সেখানে অনেকেই বসে আছেন, অনেকেই ওএসডি হয়ে আছেন। এই অতিরিক্ত জনবল কমাতে পারলে বেতন বাড়ানো কোনো সমস্যা নয়। শঙ্কার ব্যাপার হলো, সরকারের রাজস্ব আয় না বাড়লে দেখা যাবে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন খাতের ব্যয় কমানো হবে। কারণ, কোনো সরকারই প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে চায় না, তারা প্রশাসনকে চটাতে চায় না।
পে-স্কেলের কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও বাড়বে, যদি সেটা খুব বড় কিছু না-ও হয়। কারণ, বাজারে বিক্রেতারা তো সবাইকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী মনে করবেন। তাঁরা তো আর বাছবিচার করবেন না। আমাদের দেশে একরকম প্রাইস রিজিডিটি আছে, অর্থাৎ জিনিসের দাম একবার বাড়লে সেটা আর কমে না। আবার বাড়িওয়ালা ও পরিবহন মালিকেরা একদফা ভাড়া বাড়াবেন। ফলে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন খরচও বাড়বে। আরেকটি দিকে নজর দেওয়া দরকার। বেসরকারি খাতের বেতন যদি বাড়েও তাহলেও কিন্তু স্বনিয়োজিত মানুষের আয় বাড়ছে না। অর্থাৎ যাঁরা কোনো ধরনের পে-স্কেলের আওতায় নেই। তাঁরা এমনিতেই বঞ্চিত। পে-স্কেলের ধাক্কায় তাঁদের বঞ্চনার মাত্রা আরও তীব্র হবে।
এই পে-স্কেলে পেনশনের হারও বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালের বেতন স্কেলে অবসর সময় মূল বেতনের ৮০ শতাংশ ধরে সরকারি চাকুরেদের পেনশন নির্ধারণ করা হতো, আর এবারের নতুন স্কেলে মূল বেতনের ৯০ শতাংশ ধরে পেনশন নির্ধারণ করা হবে। খসড়া হিসাব করে দেখেছি, ৭০ হাজার টাকা মূল বেতনের কোনো চাকুরে পূর্ণ পেনশন সমর্পণ করলে প্রায় ১ কোটি টাকা পাবেন। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ব্যয়ের সংস্থান তো সরকারকে করতে হবে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী পেনশন তহবিল করার কথা বলেছেন, সেটা হলে ভালো কথা। তখন এই তহবিলের টাকা বিনিয়োগ করে সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন দিতে পারবে। ফলে আর রাজস্ব থেকে সেই টাকা নিতে হবে না। কিন্তু সেটা না হলে সরকারের রাজস্ব আয় প্রভূত পরিমাণে বাড়াতে হবে।
পাঁচ–ছয় বছর পর পর বেতন বাড়ালে তা খুব একটা যুক্তিসংগত হয় না। কারণ, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়। আমার মতে, স্থায়ী কর্মকমিশন করলে সুষ্ঠু ও যুক্তিসংগতভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন নিয়মিত সমন্বয় করা যাবে। শেষ কথা হলো, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা, সততা ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই পে-স্কেলের কারণে সেই পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করি। সেটা হলে জনগণই উপকৃত হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ : অর্থনীতিবিদ। সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।