দেশ কোরবানির হাট নয়

গরু ও মানুষে বিস্তর তফাত। গরু ঘাস খায়, মানুষ খায় না। মানুষ কথা বলতে পারে, কথা বানাতেও পারে চমৎকার। গরু শুধুই ডাকতে পারে হাম্বা। কথার দিকে কম হলেও মানুষের তুলনায় অনেক কিছু বেশি আছে এই প্রাণীর; যেমন—লেজ ও শিং। আবার নেইও অনেক কিছু; যেমন—লোভ-লালসা, দম্ভ, ঘৃণা, ঈর্ষা ইত্যাদি। গরুর চারটি পা, মানুষের মাত্র দুটি। এই উপরি পাওনার বিচারে নিশ্চয়ই বলা যাবে না গরুই উন্নততর। মানুষ জানে, গরুরা বুদ্ধিহীন। এ বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিত বলে, বুদ্ধিহীন মানুষকে মানুষ গরু বলে সম্বোধন করে থাকে।
মানুষের ক্রোধ সীমাহীন। গরুকুল ক্রোধবিবর্জিত নয়। হঠাৎ ফুঁসে উঠে পরস্পরকে গুঁতার উদাহরণ যথেষ্ট পাওয়া যাবে। তবু মানুষের হিসেবে, গরু নিরীহ প্রাণী।
জোর যার মুল্লুক তার, মানুষ জানে। চতুষ্পদ প্রাণীদের অজ্ঞাত, তাই সামান্য এক লাঠি বা লেজে মোচড় মেরে মানুষ গরুকে নিজের মতে চালাতে পারে। শিং আছে যার, সেই প্রাণী শিংয়ের জোর ভুলে নিরীহ থাকতে পারে, অথচ শিংবিহীন দ্বিপদবিশিষ্টরা সর্বদা অদৃশ্য শিংয়ে শাণ দিয়ে প্রস্তুত, কাকে কখন গুঁতিয়ে ধরাশায়ী করা যায়। প্রচুর পরিমাণে বুদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মানুষ যেন বেকায়দায়। কারণে-অকারণে অহরহ বুদ্ধি খরচের পথ খুঁজে বেড়ায়।
সামান্য পেছনের দিকে তাকালে গরুর ওপর বুদ্ধি খরচের খুবই নির্দয় উদাহরণ পাওয়া যাবে। কোরবানির হাটে দশাসই গরুকে ব্যাপারী মহাশয় পুঁচকে সাইজের পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। অসহ্য গরমে চারপেয়ের কষ্ট লাঘবের জন্য মানবসন্তানের অসাধারণত্বের প্রকাশ এটা নয়। যদি হতো, এই ভুবনে ‘কু’ মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে পেত না। গরুকুলে ‘সু’ আর ‘কু’ আছে কি না, সে খবর তারাই জানবে, তবে মানুষ নিশ্চিত, এই গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণীরা ভালো বা মন্দ মানুষের তফাত বুঝতে অক্ষম।
গরুকে বাতাস করার আসল কারণ জানা হলে লজ্জা-শরমে মাথা হেঁট হয়ে যাবে। গরু যত বেশি মোটাতাজা, কোরবানির গরু হিসেবে তার দাম হবে ততটাই মোটা এবং তাজা। মোটাসোটা লাভের আশায় গরুর দেহে সিরিঞ্জের মাধ্যমে ওষুধ ঢোকানোর বুদ্ধি পেয়েছে মানুষ। শিউরে ওঠার মতো কথা, সেই মন্দ ওষুধে নিরীহ গরুর কিডনি আক্রান্ত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ফুলেফেঁপে বেশি দামে বিক্রির যোগ্য হয়ে ওঠে গরু। ভাষা হারিয়ে ফেলার মতো কারবার। ধর্ম এবং মানবধর্ম—দুটিকেই গোল্লায় পাঠাতে সামান্য বুক কাঁপে না অনেক মানুষের।
গোবেচারা শব্দটি মানুষের আবিষ্কার। আবিষ্কারকালে বিশ্লেষণে বোধ হয় বের হয়েছিল, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হলেও পরিস্থিতি সেই শ্রেষ্ঠকে কখনো গো এবং কখনো বেচারায় পরিণত হতে বাধ্য করবে।
এখন অবস্থাদৃষ্টে তেমনই মনে হচ্ছে। মনে হয়, সময় সবাইকে গো বানিয়ে ছেড়েছে, বেচারায় পরিণত করেছে। যেন সবাইকে ঠেলে গুঁতিয়ে তোলা হয়েছে বিরাট হাটে। গলায় দড়ি পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে খুঁটিতে। দুই বাঁশের ফাঁকে অতি কষ্টে দাঁড়িয়ে জাবর কেটে যেতে হচ্ছে। যেন রোদ-বৃষ্টি, ঠান্ডা-গরম যা-ই হোক, দিন-রাত অসহ্য যাতনা ও কোলাহলের মধ্যে বিনা বাক্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
হাটে ইজারাদার, তার একপাল জবরদস্তিকারীর হালুম-হুলুম আছে যখন-তখন। স্থানীয় খুচরা ষণ্ডাদের ষণ্ডামি, আছে বেয়াড়া ধরনের মাছিদের ফাজলামি। মহাজন, ব্যাপারী, ফড়িয়া, ক্রেতা—কত রকম পরিচয়ের মানুষের শত রকম অন্যায়-অনাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হয় গরম হাটের ঠান্ডা গরুদের। টুঁ-শব্দ করে না তারা। অমর্যাদা কাকে বলে গরুকুলের জানা নেই, অপদস্থ হওয়া বোঝে না। সম্মান পাওয়ার অধিকার সম্পর্কে গো সম্প্রদায়ে সচেতনতা নেই। নেই বলে নিরীহের প্রতি অনিরীহের যাচ্ছেতাই আচরণ সগৌরবে চলে। মানুষের প্রতি মানুষের যেমন খুশি তেমন আচরণ শোভন নয় মোটেও।
স্বনির্ভর কথাটা গরু বেচারাদের জন্য জুতসই নয়। গৃহপালিত হওয়ায় তাদের মুখে খাবার এগিয়ে দিতে হয়। তবে তারা পরিধানের ঝামেলামুক্ত। মানুষ নিজের খায়, নিজেরটা পরে। চলে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী। মানুষকে গরু ভেবে গর্দভের মতো আচরণ করতে পারে বোকার স্বর্গে বাস করা মানুষই। গলায় দড়ি, ঠেলা-ধাক্কা, গুঁতা, ধমক-টমক বা যেকোনো প্রকার অসম্মান চারপেয়েরা টুঁ-শব্দ না করে হজম করে। দুপেয়েদের পাকস্থলী দুপেয়ে মার্কা, অত নির্বিকার স্বভাবের নয়।
গরুর হাটের দুর্ভাগা গরুরা মোটাতাজা হওয়ার সাধে স্বেচ্ছায় সুই গ্রহণ করে না, নিজ স্বার্থে লোভী ব্যাপারীরা তাদের বাধ্য করে। সেই হাটের বাইরেও চলছে সুইয়ের ব্যবহার। দেওয়া নয়, নেওয়া। কিসমত মোটাতাজা বানানোর লক্ষ্যে পক্ষ নিয়ে দক্ষ ব্যাপারী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তারা সুই নিচ্ছে স্বেচ্ছায় ও সানন্দে। সে সুইয়ের রয়েছে পরোক্ষ ক্ষমতা। তাতে ভাগ্য ফেরে নিজের, কিডনি শেষ হয়ে যায় অন্যের।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন সম্মানীয় পরিচয়ে সোনার বাংলায় পাঠিয়ে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছেন, অনেকেই প্রাপ্ত পরিচয়ে সন্তুষ্ট নয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, গবেষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি নানা পরিচয়ের মানুষের মনের মণিকোঠায় পক্ষে দক্ষ হওয়ার তীব্র বাসনা। যিনি মানুষকে বুদ্ধি প্রদান করেন, তিনিও বোকা বনে যান যখন দেখেন, কোনো বুদ্ধিপ্রাপ্ত সাগ্রহে বোকাসোকা বনে যেতে উদ্গ্রীব। তিনি বিস্ময় সৃষ্টিকারী হয়েও হতবাক হন, দুই চোখে তীব্র দৃষ্টিশক্তি দান করা সত্ত্বেও একচোখা বনে জীবন সার্থক করতে চায় বহু মানুষ।
দুই চোখ থাকতেও যারা দিবারাত্র এক চোখে দেখে সন্তুষ্ট, তাদের পক্ষে মানুষকে গরু বিবেচনা করা খুবই সম্ভব। চারদিকে সমূহ সর্বনাশ কড়া নাড়ছে, উদ্বেগ-উত্তেজনা নেই। মানুষ বেঁচে থেকে মরছে, মরেও মরছে। দুঃখের দহন নেই, শোকহীন একচোখারা খাড়া করছে যুক্তির পাহাড়। মানুষ মরুক, মানবতা হেরে যাক, পক্ষ জেতাতে হবে। এটাই যেন পরম ধর্ম।
দেশ কোরবানির হাট নয়। গরুতে ভর্তি নয় দেশ। দেশ মানুষের। মানুষের ভেতরে মানুষই পছন্দমতো নিজ নিজ পরিচয় তৈরি করে নিয়েছে, নেবে, নিক। দেশের সব মানুষ এ-ভাগ ও-ভাগে নাম লিখিয়ে বিভক্ত হতে চায় না। সিংহভাগ মানুষ সাধারণ পরিচয়েই খুশি। তাদের সাধারণত্ব দুর্বলতা নয়, বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা শ্রেয়তর। গুণ গায়ে না মাখলে কখন তা দোষে পরিণত হবে, জানবে না কেউ। তখন গোবেচারাদের দেখে একচোখাদের আক্কেল গুড়ুম হবে—আরে, এদের শিং গজাল কবে, কখন?
দুঃখের বিষয়, যখন এমন প্রশ্নের উদয় হবে, উত্তর পাওয়ার জন্য হাতে সময় থাকবে না।
 আফজাল হোসেন: লেখক, অভিনেতা, পরিচালক।
[email protected]