কী নিয়ে সময় কাটায় শিশুরা

‘আমি হব সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি’ এসব ছড়া আজকালকার ছেলেমেয়েদের জন্য আর প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে না। যেসব শিশু-কিশোরকে সকালে ক্লাসে যেতে হয়, তারা বাধ্য হয়ে সকালে উঠছে, কিন্তু ছুটি, অনিবার্য কারণ বা হরতালের টানা বন্ধে তারা তাদের জীবনধারা পাল্টে ফেলেছে। আজকাল অভিভাবকদের একটাই অভিযোগ, আমার ছেলে বা মেয়ে দুপুর বারোটা-একটায় ঘুম থেকে ওঠে, ঘুমাতে যায় ভোরের দিকে। ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলে, রাত জেগে তো পড়িই। আর সুস্থতার জন্য সাত-আট ঘণ্টা ঘুম যখন জরুরি, সেটা তো পুষিয়েই নিচ্ছি। হোক না তা দিনের বেলা। বয়োজ্যেষ্ঠরা যারপরনাই বিরক্ত। এ কী সৃষ্টিছাড়া অভ্যাস!
আসলেই কি ওরা সারা রাত লেখাপড়া করে? যতটুকু করা লাগে, তার বেশি নিশ্চয় নয়। তাহলে কী রাজকাজটা করে তারা রাত জেগে? এ তো আসলেই রাজ কি বাত। বলার অপেক্ষা রাখে না, অনেকেই সেলফোন, ফেসবুক, চ্যাটিং, স্কাইপ, ইউটিউব আর মুভিতে রাত্রি পার করে। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে ওরা—এ মিথ্যে কথা? ওদের ঘরে উঁকি দিয়েছেন? দিলে দেখবেন বিছানায়, মেঝেতে, আলমারির সামনে খুলে রাখা অগোছালো কাপড়ের স্তূপ। একদিকে জুতা-মোজার পাহাড়, অন্যদিকে কাগজপত্র, বইখাতা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। কোনো দরকারে ওদের ডাকলে এসব পাহাড়-পর্বতের মধ্যে থেকে তারা মূষিকের মতো মাথা উঁচু করে। চোখ কিন্তু নিচে। কারণ, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন থেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরানো যাবে না। টিভিও বড় একটা দেখে না। বিশেষ খবরাখবর ফেসবুকের কল্যাণে তারা আগেই জেনে যায়। বাইরে খেলাধুলা তো তাদের কাছে প্রাগৈতিহাসিক বিষয়। পাঠ্যবই ছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য বই/ম্যাগাজিন কতটা পড়ে, সেটাও জানা যায় না। ওরা বলে, মুভিতেই নাকি সব মেলে। আমি বিশেষ করে প্রযুক্তিধন্য এসব ছেলেমেয়ের কথাই বলছি।
আমরা যারা পঞ্চাশোর্ধ্ব, তাদের ছোটবেলা কেটেছে অনেক ভাইবোনের সঙ্গে, কখনো কখনো যৌথ পরিবারে অন্য কাজিনদের সঙ্গে। তখন অভিভাবকদের কড়া শাসন ছিল। নিজের কাপড় নিজে কেচে ইস্তিরি করতে হতো। পালা করে ঘরও গোছাতে হতো। অনেকে তো তাদের মায়ের সঙ্গে রান্নাতেও হাত দিত। পিতৃতন্ত্রের কল্যাণে ভাইদের ফেলে রাখা কাজ বোনেরা করে দিলেও অনেক ছেলেই মায়ের লিস্ট নিয়ে বাজার করে আনত।
কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে, তার জন্য বারবার জানালা দিয়ে রোদের নেমে যাওয়া অপেক্ষায় থাকা। রোদ থাকতে থাকতেই দলবল হাজির। বিকেলের মাঠ বা উঠোনে কৈশোরের মাতামাতি। মাসে দুই-তিনটে কিশোর ম্যাগাজিন ছিল আমাদের আনন্দের সবচেয়ে বড় উপকরণ। কেউ কেউ বড়দের বইও লুকিয়ে সাবাড় করত। পাঠাগারের জনপ্রিয় বই এহাত-ওহাত করতে করতে তুলতুলে হয়ে যেত। একই সঙ্গে আন্তকক্ষ বিনোদনের রেডিওসহ (বেশ পরে টিভি) ক্যারম আর লুডু। রেডিওর ‘অনুরোধের আসর’ রাত নয়টার মধ্যে শেষ হতো। আকাশবাণীর নাটক অপ্রাপ্তবয়স্কদের কপালে খুব একটা জুটত না। দুই ঈদে দুই সেট ভালো জামা। গোটা কয়েক আটপৌরে আর স্কুলড্রেস। দুই জোড়ার বেশি জুতা থাকত যাদের, তারা অনেক ওপরতলার মানুষ।
এর কারণ অনেক কিছুই থাকতে পারে, কিন্তু প্রধান যা, তা হচ্ছে নাগরিক জীবনে ছোট পরিবারের চাহিদা। একটি-দুটির বেশি সন্তান নেওয়ার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই এসব পরিবারের থাকে না। চাকরিজীবী নারীদের দুটির অধিক সন্তানের জন্য কোনো মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। স্লোগানই হচ্ছে: ‘দুটোর বেশি সন্তান নয়, একটি হলে ভালো হয়’। নাগরিক জীবনে যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে। নিজের কাজ নিজে করার যে শিক্ষা আমাদের প্রজন্ম পেয়েছে, আজকাল খুব নগণ্যসংখ্যক পরিবার ছাড়া ছোট পরিবারের সব মা-বাবাই তাঁদের ছোটমণিদের সে শিক্ষা দিতে ব্যর্থ। এতে যে আখেরে বাচ্চাদেরই লাভ, সেটা তারা বুঝতে চান না।
দুই-আড়াই বছরের শিশুরাও মা-বাবার স্মার্টফোন বা ট্যাব কেড়ে নিয়ে খেলতে শিখেছে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাওয়ানোর জন্য তাদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিয়ে অভিভাবকেরাই তাদের নেশার গোড়াপত্তন করে দিচ্ছেন।
কোনো এক টিভি চ্যানেলে ড. উত্তম সেন নামের এক মনোবিজ্ঞানী বলছিলেন, রাত জেগে দিনে ঘুমানো এখনকার কিশোর-কিশোরীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম ওরা দিনে পুষিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু তা রাতের ঘুমের সঙ্গে মোটেই তুলনীয় নয়। রাতের অন্ধকার ও দিনের আলোর সঙ্গে নিদ্রা ও জাগরণের শারীরিক সুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। সেটার প্রভাব তাৎক্ষণিক না হলেও অদূর ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তাকর।
সম্প্রতি ‘চাইল্ডউইশ’ নামের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের বেশির ভাগ সময় কাটে স্মার্টফোন, টিভি, ট্যাবলেট বা কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে। এত সময় ধরে পর্দায় চোখ রাখলে শিশুদের মনোজগৎ ছোট হয়ে যায়, বলছেন গবেষকেরা। এতে স্বাস্থ্যগত নানা ধরনের সমস্যায়ও ভুগতে থাকে শিশুরা। আর প্রযুক্তিতে সহজগম্যতা গ্রহণযোগ্য বয়সের আগেই চলে আসছে বলে যৌনতার কৌতূহলও তাদের নানাভাবে বিপর্যস্ত করছে। কম বয়সের শিশুদের যতটা সম্ভব পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তা না হলে প্রযুক্তিধন্য এ প্রজন্মের কেবল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে জটিলতা আসবে না, পরবর্তী সময়ে তারা সামাজিক সমস্যারও কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক ও জেন্ডারসমতাবাদী লেখক।
[email protected]