উন্নয়নের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ

রবার্ট ওয়াটকিন্স
রবার্ট ওয়াটকিন্স

জাতিসংঘ আজ মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উদ্যাপন করছে। এ বছর নাগরিক সমাজের ভূমিকা এবং নাগরিক সমাজের কার্যকারিতা ও বিকাশ নিশ্চিত করার গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সমাজকে সমৃদ্ধ করতে অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থ বিকাশে কাজ করে—এমন সংগঠন ও ব্যক্তিদের সমাবেশ হিসেবে অভিহিত করে নাগরিক সমাজকে শিথিলভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের অভিন্ন অংশ হিসেবে কাজ করে এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ন্যায়বিচার, সমতা, প্রতিনিধিত্ব, মত প্রকাশ, সংগঠনের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয় চর্চায় সহায়তা করে। এই মূল্যবোধগুলো নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সমুন্নত রাখা হয়েছে, যেখানে নাগরিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা একটি দেশ অনুমোদন করবে ও সমুন্নত রাখবে শুধু তা বলেনি, বরং তা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হিসেবেও উল্লেখ করেছে।
নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ, যা তাদের পরিচয়ের মধ্যেই গ্রথিত রয়েছে। এসব সংগঠন কোনো একক ও স্বতন্ত্র সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং তা অনেক কণ্ঠের সমাবেশ, যা মতানৈক্যের সময় অভিন্ন প্রশ্নে সবাইকে এক জায়গায় মিলিত করে জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পক্ষে মত দেয়। নাগরিক সমাজ জনগণের ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে, যেখানে লোকজন বিভিন্ন মত, আলোচনা ও সংস্কারের কথা বলে, যা হতে পারে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৃজনশীলতা ও সমাধানের উৎস।
নাগরিক সমাজের প্রবণতাই হচ্ছে মাঝে মাঝে বিদ্যমান অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা, যা আরও উদার ও অংশীদারত্বমূলক সমাজের দিকে ধাবিত হতে পারে। যার জন্য সমাজে শুধু ভিন্নমত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহনশীলতাই নয়; অর্থবহ, ইতিবাচক সংলাপ ও বিতর্কের জন্য উদারতারও প্রয়োজন। চিন্তার উদারতার অভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা থাকে, যার প্রকাশ ঘটতে পারে সহিংসভাবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। নাগরিক সমাজের জন্য সহায়ক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আদর্শিক কোনো মানদণ্ড নেই। যদিও এ ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে, নাগরিক সমাজ সেখানেই গড়ে উঠবে, যখন রাষ্ট্র কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক আইন চাপিয়ে দেবে না বরং এর পরিবর্তে নাগরিকদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করবে।
শক্তিশালী নাগরিক সমাজ যুগপৎভাবে একটি কার্যকর ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত এবং এর পরিণতি। জাতিসংঘ মনে করে, নাগরিক সমাজকে কোনো রকম বাধা-বিঘ্ন ছাড়া বিকশিত হতে দিলেই উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সবচেয়ে ভালোভাবে কার্যকর হয়। জাতিসংঘ সচিবালয়ে বর্তমানে চার হাজারের বেশি নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থা বৈশ্বিক এজেন্ডার বিভিন্ন বিষয়ে মত দেয় এবং গবেষণায় অবদান রাখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আগামী ১৫ বছরের একগুচ্ছ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারণের আলোচনাতেই শুধু নয়, এসডিজি চূড়ান্ত করতে নাগরিক সমাজ ভূমিকা রেখেছে এবং এর বাস্তবায়নেও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার থাকবে। নাগরিক সমাজ যখন সরকার থেকে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে, তখন এটি সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। আবার রাষ্ট্রের উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে সরকারের অংশীদার হয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারে, যার সুফল ভোগ করে সব জনগণ।
নাগরিক সমাজ, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের বিষয়টি সত্যিকার অর্থে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে বাংলাদেশে। গতিশীল ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজের কারণে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ছাত্র, কর্মী ও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলন, যা চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করেছে, তার মধ্যেই এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা, পরিবর্তনের পূর্বাভাস ও সুনিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের সত্যিকারের বহিঃপ্রকাশ। ক্ষুদ্রঋণ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সাহায্য সংস্থার জন্মস্থান হওয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার পর অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়েছে।
আজ বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ তার দেশজ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে, যা দেশে দুই হাজারের বেশি জাতীয় নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থা এবং এর চেয়ে বেশি সংখ্যায় সমাজভিত্তিক গোষ্ঠীকে নিয়ে সবার জন্য আরও উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। যখন বৈচিত্র্যময় ও বহুমতের কণ্ঠস্বরগুলো একটি অবাধ ও মুক্ত গণতন্ত্রে চলমান থাকে, তখন অভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকারের সেরা সহযোগী হিসেবে কাজ করে নাগরিক সমাজ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের অবস্থানে প্রবেশ করেছে, সে সময়টাতে দেশের সেরা ঐতিহ্যগুলোকে মনে করাটা সংগত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ যখন দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন, তখন সুস্থ মত ও চিন্তার চর্চা বিকাশের ধারা বজায় রাখতে যথাযথ পরিবেশ যাতে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে আমাদের সবাইকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
রবার্ট ওয়াটকিন্স: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী