বিক্ষোভের মাইনফিল্ডে সাবধানে পা ফেলুন

রাজনীতিহীনতার কালে এ রকম ঘটনা ঘটে। ঘটবে। কালিহাতীতে নারী নির্যাতন ও থানা ঘেরাওয়ের মিছিলে গুলির ঘটনায় রাজনীতির ওপরতলার ঘুম ভাঙবে না হয়তো। কিন্তু তিনটি প্রাণের মূল্যে এই দেশের যে গভীর সংকটের প্রকাশ ঘটল, এই প্রাণগুলোর মতোই সেই সত্যটাও অদম্য। উপেক্ষা করার উপায় নেই।

প্রায় প্রতিটি জনতা বনাম ক্ষমতার সংঘাত থেকে একটি জ্বলন্ত সত্যই বিকিরিত হয়। তা হলো, সমঝোতা নয়, বলপ্রয়োগই মোক্ষ। যেখানে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা আছে, সেখানে রাষ্ট্র-প্রশাসন সমঝোতার সুযোগকে হেলায় নষ্ট করে। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে কালো অধ্যায় রচিত হলো যে ঘটনায়, সেই প্রেম বা প্রেমহীনতার মীমাংসা পারিবারিকভাবেই হতে পারত। যে ব্যক্তির স্ত্রী তাঁর সঙ্গে সংসার করতে রাজি নন, তাঁকে জোর করে রাখতে হবে কেন? পরিবারের মুরব্বিরা চেষ্টা করবেন, গ্রামের সামাজিক নেতারা চেষ্টা করবেন আপস-মীমাংসার। তারপরও মীমাংসা না হলে আইন ছিল। কিন্তু রফিকুল ইসলাম নামের লোকটি সে পথে গেলেন না। তিনি চলে যাওয়া স্ত্রীকে জোর করে ধরে আনলেন। তিনি এলাকায় প্রভাবশালী এক নেতার ছোট ভাই আর নির্যাতিত তরুণ ও তাঁর মা ক্ষমতাবর্জিত শ্রমজীবী। পুরুষের ব্যাটাগিরির অহংকারের সঙ্গে ক্ষমতার দম্ভ মিলে যে চেতনানাশক সৃষ্টি হলো, তা-ই ঘটাল এক ক্ষমাহীন অপরাধ। এটা শুধু বলপ্রয়োগ নয়, বলপ্রয়োগের দ্বারা সর্বোচ্চ যে পাশবিকতা করা সম্ভব, সেটাই রফিকুল করলেন। তিনি ও তাঁর সেঙাতেরা তাঁর স্ত্রীর প্রেমিক ও তাঁর মাকে বাড়িতে ধরে আনলেন। বিবস্ত্র করে পেটালেন এবং আরও কিছু করলেন যা কল্পনাতীত রকম বীভৎস। এ রকম ঘটনার অভিঘাত সাধারণ মানুষকে বিহ্বল ও বিদ্রোহী দুটোই করতে পারে।
এই খবর গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ল। গুজবের মধ্যে সত্যের সঙ্গে কল্পনার রং মিশল। গুজব হলো জনতার মিডিয়া, দুষ্কালে এটা মারাত্মক অস্থিতিশীলতার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তারা জানতে পারল, ওই প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বামীর বাড়িতে ভাড়া থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রশ্রয়ও নাকি ছিল। এমন অভিযোগ মানুষকে পুলিশের প্রতিও ক্ষিপ্ত করে তুলল। এবং তারা নারী-পুরুষ, কিশোর-বৃদ্ধ মিলে শয়ে শয়ে থানা ঘেরাওয়ে রওনা হলো। থানার পুলিশ যথারীতি লাঠি ও টিয়ার গ্যাস চালাল। তাতেও কাজ না হলে পুলিশ তার বন্দুকের ব্যবহার করে বসল। রাস্তায় পড়ে থাকল তিনজনের লাশ, আহত হলো ৫০ জন।
রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করার পরও কেন থানা ঘেরাও করতে গেল জনতা, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমেই এই প্রশ্নের নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া সম্ভব। আমাদের অনুমান, রফিকুল ইসলাম প্রভাবশালী হওয়ায়, থানার কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা থাকায়, এলাকাবাসী থানার ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। অহরহ এ রকম আস্থা ভঙ্গের অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা সন্দিহান হবেই। যখন হাজার হাজার মানুষ শক্ত কোনো অবস্থান নেয়, তখন যাবতীয় কর্তৃপক্ষের উচিত ধৈর্য ধারণ করা, মানুষের কথা শোনা, আস্থা অর্জনের চেষ্টা করা, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাদের ভরসা হওয়ার দরকার তখন। এ দায়িত্বটা প্রথমত, এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষ করে সরকারি দলের নেতাদের, যেহেতু বিরোধী দল কার্যত বিলীন।
দ্বিতীয়ত, জেলার প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের। তৃতীয়ত, ঘটনার মধ্যে পড়া পুলিশ কর্মকর্তাদের। কিন্তু মিডিয়ার বিবরণ থেকে মনে হয়, কেউই আন্তরিক চেষ্টা করেনি। এলাকার সাবেক সাংসদ লতিফ সিদ্দিকী পদ হারিয়েছেন, এলাকায় যাওয়াতেও তাঁর ভয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদেরও কি তেমনই জনবিচ্ছিন্ন অবস্থা? তা-ই যদি না হবে, তবে তাঁরা মধ্যস্থতার চেষ্টা করেননি কেন? প্রশাসনের কর্তারাই বা কী করেছেন? বিক্ষোভ বজ্রপাতের মতো আকস্মিকভাবে আকাশ থেকে পড়েনি। প্রতিবাদের ডাক থেকে গুলিবর্ষণের ঘটনার মধ্যে অনেক সময় গেছে, এর মধ্যে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় অন্তত কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার ছিল। অভিজ্ঞতা বলে, আন্তরিক কোনো চেষ্টাই একেবারে বিফল হয় না। থানা ঘেরাও থেকেও জনতাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ফেরত পাঠানোর অনেক ঘটনা এই দেশে আছে।
কিন্তু দেশ যেভাবে রাজনীতিহীন হয়ে পড়ছে, রাজনীতি যেভাবে জননেতাহীন হয়ে পড়েছে, আর হঠাৎ নেতারা যেভাবে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলছেন, তাতে আসলেই মধ্যস্থতা করার যোগ্য কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দলাদলি ও জনরোষের ভয়েও কোনো কোনো নেতা এলাকাছাড়া থাকেন। এ রকম অবস্থায় পুলিশও অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিল না। জনতার বিপরীতে তারা তাদের হাতে অর্পিত ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার করে বসল, গুলি করল, তিনটি জীবনের ইতি ঘটল। দায় হলো পুলিশের, বদনাম হলো সরকারের।
রাজনীতিক, প্রশাসক ও পুলিশের তরফে এই যে বলপ্রয়োগের তরিকা নেওয়া হলো, এটা আইনেরও বরখেলাপ, রাজনৈতিক দক্ষতারও ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে সমাজের গভীরে প্রোথিত এক অগণতান্ত্রিক বিশ্বাস যে ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। এ বিশ্বাসে জনতাও দারুণ আসক্ত। দেখা যায়, ছোটখাটো অপরাধী থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রতিপক্ষকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও উসকানি দিয়ে জনতাকে গণপিটুনির দিকে ঠেলেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা যে একসময় কিছুটা জনসমর্থন পেয়েছিল, তারও মূলে আছে এই বন্য বিশ্বাস।
রাজনীতি মানে ক্ষমতার বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা। বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা সম্ভব তখনই, যখন অনেকগুলো পক্ষ পরস্পরের মধ্যে ক্ষমতা ও অধিকার ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতে রাজি থাকে। আইনের সারকথাও এই যে বৃহত্তর ন্যায়ের স্বার্থে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রিত নৈর্ব্যক্তিক ব্যবহার করা যাবে। বিচার মানে প্রতিহিংসা নয়। অথচ আমাদের সমাজে এই অংশীদারি, অধিকার ও ন্যায়ের ধারণায় কারওরই খুব একটা বিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না। এগুলো নিছক বাত কি বাত, মুখের বুলি। এ রকম দশায় যদি মানুষের কাছে আইনকে ক্ষমতাবানের অস্ত্র বলে মনে হয়, ক্ষমতাবানেরাও যদি আইনকে প্রতিহিংসার আনন্দে ব্যবহার করেন, তখন আইনের মর্মে ওই ন্যায় ও মীমাংসার ধারণাটি ধ্বংস হয়। তখনই বিদ্রোহকে ন্যায়সংগত ভাবার পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই আইন নিজের হাতে যে-ই তুলে নিক, তা ওই থানা ঘেরাওকারী জনতা বা পুলিশ, উভয়ে মিলেই আসলে পাল্টাপাল্টি বলপ্রয়োগের অসম লড়াইয়ে নেমে পড়ে।
পরাধীন দেশে জনতা ও ক্ষমতার এ রকম প্রতিপক্ষতা মানায়, কারণ ক্ষমতা ছিল গণবিরোধী। কিন্তু স্বাধীন দেশের শাসকেরা কেন ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়বেন? কেন জনতার প্রতিবাদকে তাঁদের অসহ্য মনে হবে? গণতন্ত্রে কি প্রতিবাদ দেখলেই রেড সিগন্যাল দেখাতে হবে? ভিন্নমত প্রতিবাদ ও আন্দোলন ছাড়া কি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র কল্পনা করা যায়?
‘মাইর ছাড়া ওষুধ নাই’ ধারণা থেকে সরে না এলে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে হানাহানি চলবেই। একদিকে মার খাওয়া জনতা, অন্যদিকে মার দিতে উৎসাহী পুলিশ। ভ্যাটবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে রাবার বুলেট চলেছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোয় বামপন্থীদের প্রতিবাদ বলপ্রয়োগ দিয়ে ভেস্তে দেওয়া হলো, যৌক্তিক বিরোধিতাকে ষড়যন্ত্র ভাবা হচ্ছে। এ রকম চললে দেশ রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়ে, জনতা ও ক্ষমতার বিচ্ছেদ ঘটে। আর তখনই বিক্ষুব্ধ সমাজ হয়ে ওঠে বিক্ষোভের মাইনফিল্ড। এ রকম সময় বেমক্কা ভুল জায়গায় পা পড়েছে তো ফক্কাস, একেবারে তুলকালাম! তাই, সাবধানে পা ফেলুন। কারণ নিচুতলা উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

আরও পড়ুন: