নিউইয়র্ক মুক্তধারার রজত জয়ন্তীতে

আমি নিউইয়র্কে যাই, যেতে পছন্দ করি, তার একটা কারণ নিউইয়র্কের মুক্তধারা। মুক্তধারা ২৫ বছর ধরে নিউইয়র্কে বইমেলা করে। বাংলা বইয়ের মেলা। এ কি যা-তা কথা! বই কি কেউ আনন্দের সঙ্গে কেনে? ইরানে এক বিচারক শাস্তি হিসাবে অপরাধীদের ৫টা করে বই কেনা, পড়া, সেই বই পড়েছেন কিনা তার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই বই কেনা এবং পড়াটা শাস্তি। বাংলা বই পড়া তো দ্বিগুণ সাজা। আর নিউ ইয়র্কে বসে বাংলা বই পড়াটা হওয়ার কথা তিনগুণ সাজার মতোন। অথচ এমন একটা কঠিন কাজে হাত দিলেন বিশ্বজিৎ সাহা, প্রবাসে বাংলা বই আনলেন, বাংলা নাটক-সিনেমা গান আনলেন, আর সেসব বিক্রি করার ব্যবস্থা করলেন। তুষারের মধ্যে একটা ট্রলিতে বই নিয়ে বিমানবন্দর থেকে ঠেলে নিয়ে আসছেন বিশ্বজিৎ, তার হাঁটু ভেঙে আসছে, পা ফেটে যাচ্ছে--এই দৃশ্য আমি কল্পনায় দেখতে পাই। শুধু বই বা ক্যাসেটের বিকিকিনি নয়, তিনি বইমেলা আয়োজন করতে লাগলেন। মুক্তধারা হলো, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন হলো। বাংলাদেশ থেকে লেখকদেরকে, কলকাতা থেকে লেখকদের তিনি উড়িয়ে আনতে লাগলেন নিউইয়র্কের বইমেলায়। মুক্তধারা ছাড়া আর কে বিমানের ভাড়া দিয়ে লেখকদের প্রতিবছর নিয়ে গেছে প্রবাসে, এমন ঘটা করে। লেখকেরা গেছেন, শিল্পীরা গেছেন। কোনো শিল্পীর ক্ষমতা আছে তারা দর্শকশ্রোতাকে টানতে পারেন, কিন্তু লেখকদের কাছে সেটা আশা করা বাতুলতা হবে। তবুও মুক্তধারা ফি বছর লেখকদের নিয়ে গেছে নিউইয়র্কে, কোনো কোনো বার অন্যান্য শহরে, বইমেলা করেছে।

কত তার সমালোচনা হয়েছে। কাঁটার আঘাতে তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। রক্ত ঝরেছে। একা একা কেঁদেছেন বিশ্বজিৎ, কিন্তু থেমে যাননি। প্রবাসে শহীদ মিনার হয়েছে, এখন তো একুশে ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এসবের পেছনে মুক্তধারার অবদান আছে।
আমি বহুবার গেছি মুক্তধারার অনুষ্ঠানে, বইমেলায়। একবার গেছি উদ্বোধক হিসাবে। তাদের নিয়ম, প্রতিবার নতুন কাউকে সেখানে নেয়া হবে, উদ্বোধক হিসাবে। এই কারণেই খুবই জুনিয়র একজন লেখক হওয়া সত্ত্বেও একবার আমি এই সম্মানটা লাভ করেছিলাম, যার যোগ্য আমি কখনও ছিলাম না। কিন্তু তারপরেও আমি গেছি মুক্তধারার অনুষ্ঠানে। একবার গেছি নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস হয়ে ডালাসে। সঙ্গে ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান, শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু, হাবিব, শ্রীকান্ত।
প্রথমবার গিয়ে তো হতবাক হয়ে গেছি। বোস্টন থেকে, ফ্লোরিডা থেকে বাংলাদেশীরা চলে এসেছেন বইমেলায়। তখন আমার ‘৫১ বর্তী’ নাটক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, ‘মা’ বেরিয়ে গেছে--কাজেই এই ভদ্রলোকেরা এসে আমার সঙ্গে ‘৫১ বর্তী’ নিয়ে বা ‘মা’ নিয়ে কথা বলছেন। বাহবা। প্রবাসে আমাদের এত দর্শক। এত পাঠক। দেখে-শুনে কথা বলে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
বিশ্বজিৎ সাহার পাশে থাকেন হাসান ফেরদৌস ভাই। তাঁর অভিভাবকত্ব দিয়ে, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে তিনি নিউইয়র্ক বইমেলার কার্যক্রমকে আলোকিত করে রাখেন।
ইদানীংকালের অনুষ্ঠানগুলোয় একটা বিশাল পরিবর্তন দেখি। আমেরিকায় বড় হওয়া নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকে। তারা একমিনিটও দেরি করতে চায় না। ১০টা মানে তাদের কাছে ১০ টা,৫টা মানে ৫ টা। একবার তো আমি আধঘন্টা পরে যাই ভেবে আস্তে আস্তে আসছি অনুষ্ঠানস্থলে, ফোনের পরে ফোন, ‘আনিস কাকু, আপনি কোথা?’ ; আমি অনুষ্ঠানস্থলের গেটে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল সবাই। গিয়ে দেখি, উদ্বোধন প্রায় শেষ। আমি গিয়ে কোনো রকমে একটা ফটোর ফ্রেমে ঢুকতে পারলাম।
এটাই তো চাই। মুক্তধারা বাংলা ভাষার মশালটা নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছে। এবার তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলার আলো, প্রবাসের পথে-প্রান্তরে।
আমার কী যে ভালো লাগে। কাজেই আমি যুক্তরাষ্ট্রে গেলে খোঁজ নিই, মুক্তধারার কোনো অনুষ্ঠান আছে নাকি। যদি থাকে, আমাকে বলার আগেই সেদিন আমি নিউ ইয়র্কে গিয়ে হাজির।
মুক্তধারার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। জয় হোক, মুক্তধারা।