অপরাধীরা শাস্তি পাবে কবে?

রামু সহিংসতা
রামু সহিংসতা

রামুর বৌদ্ধপল্লি ও বৌদ্ধমন্দিরে হামলার তিন বছর পূর্ণ হয় ২৯ সেপ্টেম্বর। উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ায় পূর্ণ হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হামলার রাতের পরদিন ছিল মধুপূর্ণিমা। এবারের মধুপূর্ণিমা আগের দিন ২৮ সেপ্টেম্বর উদ্যাপিত হয়েছে। ২০১২ সালের মধুপূর্ণিমা তিক্ত অভিজ্ঞতার হলেও এবারের মধুপূর্ণিমা উদ্যাপন মধুময় হয়েছে, সন্দেহ নেই। তবে রামু সহিংসতার বিচারের ক্ষেত্রে এখনো সুসংবাদ নেই।
২০১২ সালে রামু সহিংসতা ঘটার পর ২০১৩ সালে পুলিশ ১৯ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে। তার মধ্যে রামুর আট মামলায় ৩২৮ জন, উখিয়ার সাত মামলায় ১৮৩ জন এবং কক্সবাজার সদরের দুই মামলায় ১০৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। রামু ও উখিয়ার ১৫ মামলার অভিযোগপত্র থেকে মোট ৫৫ জনকে বাদ দেওয়া হয়। রামুর আট মামলার একটি ২০১৫ সালের মার্চ মাসে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। নিষ্পত্তি হওয়া এই মামলার ৩৮ জন আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। বিনা বিচারে এক মামলার রায় হয়ে গেল।
রামুর আট মামলার সাতটি হলো পুলিশ বাদী মামলা। শুধু নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া এই মামলাটিই ছিল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির করা। এখন এই মামলাটিই আগে মাঠে মারা গেল। অন্যান্য মামলার অবস্থাও ভালো নয়। সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে সব মামলার একই পরিণতি হবে বলে মনে হয়।
রামু সহিংসতার প্রথম বর্ষ স্মরণ অনুষ্ঠানে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক আইনজীবী সুলতানা কামাল বলেন, ‘৪০ বছর পর হলেও দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। প্রয়োজনে ৪০ বছর পর হলেও রামু সহিংসতার বিচার হতে হবে।’ তবে এ ঘটনার বিচার হতে ৪০ বছরের প্রয়োজন হবে বলে আমরা মনে করি না। বিচার শুরু হয়েছে। ঘটনার পরপর সাক্ষীদের মধ্যে যে গতি ছিল, তিন বছরের ব্যবধানে তাতে ভাটা পড়েছে। সাক্ষীরা এখন সাক্ষ্য দেওয়াটাকে বাড়তি ঝামেলা মনে করতে পারেন। আর সাক্ষীর অভাবে মামলার কী রায় হতে পারে, তা তো সবার জানা।
এই প্রেক্ষাপটে গত ১৯ জুন লোহাগাড়া-সাতকানিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম আলুরঘাট ডলুকুল বৌদ্ধপল্লিতে একই ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও পল্লি আক্রান্ত হয়েছে।
রামু সহিংসতায় আক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা মনে করেছিলাম, ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত হলেও সাধারণ মানুষ হুজুগের বশে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ক্ষুদ্র হলেও সাম্প্রদায়িক একটি অংশ যে আমাদের দেশে ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, এটা বারবার প্রমাণিত বিষয়। এই সত্যটাকে যখন অস্বীকার করা হয়, তখন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, সহিংসতা, লুটপাট ও ভূমিদস্যুতা তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে—এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগারও কারণ নেই। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা ন্যায্য অধিকার নিয়ে সবার সঙ্গে শান্তিতে মিলেমিশে এ দেশে বাঁচতে চাই। তবে এ–ও স্বীকার করছি যে হামলাকারীরা বাদে দেশের সর্বস্তরের মানুষ জাতি-ধর্ম-দল–মতনির্বিশেষে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
রামুর ঘটনাসহ সব সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতার বিচার সম্পন্ন করে নজির স্থাপন করা জরুরি, যাতে সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসীরা স্পষ্ট বার্তা পায় যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড সরকার বরদাশত করবে না। রাষ্ট্র সংবিধান সংশোধন করে কোনো জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু কোনো জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এসব মৌলিক উদ্যোগ নিতে পারে না কেন? রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারেও এসব বিষয় স্থান পায় না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে আপাতত এমন ইশতেহারের কোনো বালাই নেই।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ত্রাণ যেমন দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার পরিত্রাণ। এই পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র যদি দায়মুক্তি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাহলে এটা সম্ভব।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের আবাসিক পরিচালক।

আরও পড়ুন: