সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর কি ভূরাজনীতির শিকার?

চট্টগ্রাম বন্দর এখন আর বড়সড় জাহাজের সমুদ্রবন্দর নেই, তা লাইটারেজ পোর্টে পরিণত হয়েছে
চট্টগ্রাম বন্দর এখন আর বড়সড় জাহাজের সমুদ্রবন্দর নেই, তা লাইটারেজ পোর্টে পরিণত হয়েছে

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম নগর শাখার সভাপতি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রামের সঙ্গে সরকারের প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন, যা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা, আন্দোলন-সংগ্রামে বহুল-পরীক্ষিত মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন তাঁর নিজের দলের সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুললেন, তখন বিষয়টির গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছি। ব্যাপারটি যে সত্যিই গুরুতর, তা বোঝা গেল ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পাল্টা অভিযোগে, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী সত্যের অপলাপ করেছেন।’ আমার ধারণা, মহিউদ্দিন চৌধুরী সত্য কথাটাই বলেছেন। চট্টগ্রামের জনগণের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যে একটা সত্য গোপন করার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? সোনাদিয়ার প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে কেন সরে আসা হয়েছে, সেটা জনগণের অজানা নয় (যদিও অতিরিক্ত ব্যয়ের অজুহাত দেখানো হচ্ছে। ইদানীং অনেকে পরিবেশগতভাবে সোনাদিয়া নাজুক বলেও খোঁড়া যুক্তি তুলছেন)
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে অনেক দূর অগ্রগতি হয়েছিল, বেশ কয়েক বছর আগে জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ব্যাপারে ফিজিবিলিটি স্টাডিও সম্পন্ন করা হয়েছিল। সে ফিজিবিলিটি স্টাডিতে ২৫ বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের পর্যায়ক্রমিক উন্নয়নের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। ধাপে ধাপে ওই বন্দরটি উন্নয়নের কথা ছিল। গভীর সমুদ্রবন্দরটি আঞ্চলিকভাবে প্রধানত বাংলাদেশ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স (আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মিজোরাম), নেপাল, ভুটান, চীনের ইউয়ান ও সিচুয়ান প্রদেশ এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় কিছু প্রদেশ দ্বারা ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর জন্য বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার মিলে বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর (যেটিকে কুনমিং ইনিশিয়েটিভ বলা হয়) গঠন করার ব্যাপারেও চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল।
এর মধ্যে চীন সোনাদিয়া বন্দরে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং ২০১২ সালে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট (তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট) শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য। পরবর্তী সময়ে আলাপ-আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবার যখন চীন সফরে গেলেন, তখন একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। ওই পর্যায়ে ভারত এই প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে বলে অভিযোগ আছে। বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে প্রধান কারণ হলো, কোনো কোনো দেশ চীনকে বঙ্গোপসাগরে সহজ প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ, এটি তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। এর ফলে শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়টি শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যাওয়ায় সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
কারণ, ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে এবং মিয়ানমার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর ও বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের যে একটা সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকেও মিয়ানমার সরে এসেছে। বলতে গেলে, অদূর ভবিষ্যতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এর আগে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সহায়তা করেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে যখন সম্পর্ক ভালো ছিল, তখন সিতওয়েতেও (আগের আকিয়াব) চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদারেও একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন অর্থায়ন করেছে, যেটা ভারতের অপছন্দের। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষে হেরে গেছেন এবং পরে সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজে জিতলেও তাঁর দল হেরে গেছে। সুতরাং প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আবার বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে এবং চীনের সম্পর্ক অনেকখানি শীতল হয়ে পড়েছে। অতএব সত্যের খাতিরে বলতে হবে, যদিও ভারত চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলছে, কিন্তু আসলে ভারত চীনকে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে তার ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে। এর ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতার পুরো বিষয়টিই এখন বাধাগ্রস্ত হয়ে গেছে।
সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্পটি যে আসলে বাংলাদেশের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মধ্যে আর অন্তর্ভুক্ত নেই, সেটা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী স্বীকারও করেছেন।
প্রকৃত বাস্তবতা হলো কয়লা এবং এলএনজি আমদানির জন্য মহেশখালীর মাতারবাড়িতে জাপানের অর্থায়নে একটি বন্দর-সুবিধা গড়ে তোলা হচ্ছে, যে বন্দরটি গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন হয়তো কিছুটা মেটাবে। ইতিমধ্যে সেখানে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং কাজ শুরু করা হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা নদীর মোহনায় পায়রা বন্দর নামে আরেকটি বন্দর গড়ে তোলার জন্য জোরেশোরে কাজ শুরু হয়েছে এবং প্রাথমিক কাজের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ফান্ড থেকে এই পায়রা বন্দরটি গড়ে তোলার জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং পায়রা বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সেভেন সিস্টার্সের সমুদ্রের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বন্দর-সুবিধা ব্যবহারের প্রয়োজন মিটবে, আর বাকিটার জন্য ভারত একটা
বিকল্প ব্যবস্থা করেছে কালাদান রিভার প্রজেক্টের মাধ্যমে। এই প্রজেক্টটির মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো মিজোরাম হয়ে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এই প্রজেক্টের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তা সম্পন্ন হলে
সেভেন সিস্টার্সের জন্য একটি বিকল্প জলপথ ভারতের দিক থেকে খুলে যাবে। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর প্রতি সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিশেষ দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক, সেহেতু পায়রা বন্দরটি দ্রুত গড়ে তোলা হচ্ছে। এমনকি বলা হচ্ছে এটি আঞ্চলিক গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো এ দাবির ভিত্তি নেহাত দুর্বল।
সরকার বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জনপ্রিয়তা অর্জনে পায়রা বন্দর গড়ে তুলছে, এই বন্দরের অর্থায়নও করা হচ্ছে
চট্টগ্রাম বন্দরের টাকায়। প্রতারণার অভিযোগটি উঠছে এখানেই। চট্টগ্রামের জনগণের স্বার্থে আঘাত এলে সবার আগে প্রতিবাদ জানান মহিউদ্দিন চৌধুরী, এটা নব্বই দশকের স্টিভিডোিরং সার্ভিসেস অব আমেরিকা (এসএসএ) সংকটেও প্রমাণিত। চট্টগ্রাম তার উন্নয়নের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়াতেই তিনি এবারও প্রতিবাদে নেমেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, চট্টগ্রাম বন্দর এখন আর বড়সড় জাহাজের সমুদ্রবন্দর নেই, তা লাইটারেজ পোর্টে পরিণত হয়েছে। কারণ, চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ মিটারের বেশি ড্রাফটের (গভীরতার) জাহাজ ঢুকতে পারে না। জাহাজগুলো আউটার অ্যাংকরেজে নোঙর করে, অথবা একেবারে কুতুবদিয়ার কাছাকাছি অবস্থান করে। আউটার অ্যাংকরেজ বা কুতুবদিয়া থেকে লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে মালামালগুলো
চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। অথবা সরাসরি সিঙ্গাপুরে মাদার ভেসেলগুলো মালপত্র নামিয়ে দেয়, তারপর কনটেইনার ভেসেলের মাধ্যমে সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য খুব যত্নবান প্রয়াস আমরা
দেখতে পাচ্ছি না। কারণ, কয়েক বছর আগে কর্ণফুলী নদীতে যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছিল, সেটা অসমাপ্ত অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। প্রজেক্টের প্রায় অর্ধেক অর্থ লোপাট করে দিয়ে ঠিকাদার ভেগেছেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের তেমন কিছুই হয়নি। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়েনি। একই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর খাঁড়ির গভীরতা বাড়ার পরিবর্তে গত দু–তিন বছরে আরও কমেছে।
সুতরাং এই যে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি একধরনের বিমাতাসুলভ অবহেলার দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা আসলে দেশের জন্য খুব একটা স্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গি নয়। এটা সংকীর্ণ আঞ্চলিক দোষে দুষ্ট। আমি মনে করি, গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়টি বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও কৌশলগত গুরুত্বের দাবিদার একটা প্রকল্প। পায়রা বন্দর নির্মাণকে আমরা স্বাগত জানাই। অদূর ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে তৃতীয় এই বন্দর নিঃসন্দেহে অবদান রাখবে, আঞ্চলিক প্রয়োজনও কিছুটা মিটবে এর মাধ্যমে।
সবাইকে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই, একটু সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা থেকে পুরো বাংলাদেশের যে সমুদ্র উপকূল, এর একটা বিরাট সম্ভাবনা আছে আঞ্চলিক ব্যবহারের জন্য। কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমার এমনকি থাইল্যান্ডের কিছু এলাকাকেও বাংলাদেশের এই সমুদ্র উপকূলের অর্থনৈতিক পশ্চাদ্ভূমি হিসেবে বিবেচনার সুযোগ আছে। এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার না করে আমরা যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজটি পরিত্যাগ করেছি বলে মনে হচ্ছে, সেটা দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ভারত যদি চীনকে সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে বিরত রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে
চাপ দেয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত ওই বন্দর নির্মাণের বিকল্প অর্থায়নের জন্য ভারতকে চাপ দেওয়া। এ ব্যাপারে ভারতকে একতরফা সুবিধা প্রদান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পরিপন্থী বলে মনে করি।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।