কাবিলার বাইরের সেই মানুষেরা কোথায়?

আমরা পালাচ্ছি, জ্বলছি, পথ খুঁজছি: হরতালের আগের দিন দুপুর। মানুষভর্তি অনেক বাস। মাইক বাজছে, স্লোগান হচ্ছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পোশাকশ্রমিকদের আনা হয়েছে। বস্তিবাসীদের হাঁটাপথে রওনা করানো হচ্ছে। মহাসমারোহে সবাই যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায়। এবং মহাসমারোহে ঢাকার রাজপথ থমকে আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ, জনসভার মানুষ, কাজকর্মে বেরোনো মানুষ, কেউই চলতে পারছে না। হরতালের আগের সন্ধ্যার প্রস্তুতি ছিল, ভরদুপুরে থমকে যেতে হবে কে ভাবতে পেরেছিল? বিরোধী দল যেমন হরতালের আগে হুমকি দেয়, সরকারি দলও মহাসভার দিন সেভাবে হুঁশিয়ার করলেই পারে!
সন্ধ্যায় রাস্তায় ভুতুড়ে পরিস্থিতি। সড়কবাতি থাকার পরও অন্ধকার জমে আছে। রাস্তায় গাড়ি কম, তাই গাড়ির হেডলাইটের আলোও কম। দেশের হেডলাইটও কি এ রকম নিবু নিবু? অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখা যাবে তো? হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। সন্ধ্যা পেরোতে চলল, এখনই বাড়ি ফিরতে না পারলে রাতের ভুতুড়ে ঢাকায় পুলিশ অথবা পিকেটারের পাল্লায় পড়ার ভয়। হেঁটেই রওনা হলাম গন্তব্যে। রাস্তায় পুলিশ আর পুলিশ। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে যাওয়া নগর, ভয়ের জালের তলায় আটকে পড়া জীবন। সবই গণতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের জন্য! অথচ এই দুই-ই দুই দলের কারণে আজ বিপদে।
গোপালগঞ্জ বনাম বগুড়া: রাত ১২টার দিকে ফিরছি। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ মোড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুর সঙ্গে চা খাচ্ছি। একটা প্রাইভেট কার পাশ দিয়ে ধীরগতিতে যেতে যেতে থামল। তিন যুবক নামল সেখান থেকে, হাতে লাঠি। নেমেই বুড়ো দোকানিকে ধমক, দোকান খোলা কেন? দোকান খোলা থাকলেই মানুষ আসে, তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমস্যা হয়। বুঝলাম, ওনারা সিভিল পোশাকের পুলিশ। ওপর মহলের চাপে আছে, তাই মানুষকে ভয় পাচ্ছে এবং ভয় দেখাচ্ছে। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ। কথাবার্তায় ভুল হলেই বিপদ। তেমন বিপদের মুখেই পড়লাম যেন। দোকানিকে ছেড়ে পুলিশ আমাদের নিয়ে পড়ল। আগে শরীর তল্লাশি পরে কথা: কেন এখানে এসেছি, বাসা কোথায় ইত্যাদি। কোনো উত্তরেই তারা খুশি হয় না। দলটির কর্তাব্যক্তি যিনি তাঁর চ্যাতব্যাত কিছু কম। কিন্তু সঙ্গের এসআইটি ধমক ছাড়া কথা বলেন না। হয়তো সম্প্রতি ছাত্রসংগঠনের ক্যাডার থেকে পুলিশে এসেছেন। অবশ্য পুলিশ আর ক্যাডারের মধ্যে পার্থক্য তো কেবল পোশাকে। যা হোক, বাড়ির কথা বলায় বললাম, বগুড়া। জেলাটির নাম শুনেই তাঁরা যেন আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’ টাইপের খুশি হয়ে উঠলেন। ওসি সাহেব লাঠি দুলিয়ে দুলিয়ে শোনালেন, ‘এই তো, আপনার গোড়াতেই তো দোষ, ঠিকানা ধরে গেলে তো আরও দোষ মিলব।’ বললাম, ‘বগুড়ায় জন্মালে সমস্যা কী? গত নির্বাচনে কি বগুড়ায় আওয়ামী লীগ জেতে নাই?’ তিনি সর্বদর্শী: ‘বগুড়ার লোক ভালো হয় নাকি?’ ওনার বাড়ি গোপালগঞ্জে। ভাবতে থাকলাম, জন্মস্থান তো বদলানো যায় না, কিন্তু বুদ্ধি করে যদি গোপালগঞ্জে শ্বশুরবাড়ি বানাতাম, তাহলে যে সরকারই আসুক, অসুবিধা হতো না।
একদিকে বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জ অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের বগুড়া। বাংলাদেশ তাহলে কোথায় হারাল? গোপালগঞ্জ আর বগুড়া কীভাবে ঢেকে ফেলল বাংলাদেশকে? দুই জোটের সমর্থক নন, এমন মানুষদের কি হাতিয়া বা সোনাদিয়ায় পাঠানো হবে? সাতচল্লিশের দেশভাগ, একাত্তরের স্বাধীনতার পরও দেখি, দেশভাগ শেষ হচ্ছে না। দুই দল মিলে দেশটাকে এমনভাবে ভাগ করে ফেলেছে যে বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা কঠিন। পথ বন্ধ। দুই পক্ষের সাঁড়াশি চাপে বাংলাদেশ নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। সরকারের এখন সবাইকেই সন্দেহ। কোনো সরকার যতই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, ততই ক্ষমতার লাঠি আঁকড়ে ধরে। জনগণের স্বাভাবিক নড়াচড়াতেও তখন তাদের ভয়। তাঁরা কি জানেন, এই সন্দেহ, তল্লাশি, হুমকি
মানুষ কীভাবে দেখছে? অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত যে গণতন্ত্র চায়, তার জন্মের উৎসবে ককটেলের বিস্ফোরণ আর আগুনের হলকা ছাড়া আর কিছু নেই। এ এমন গণতন্ত্র, যার জন্য সরকারকে করতে হয় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর বিরোধী দলকে চালাতে হয় নৈরাজ্য! জনসমাজকে অসহায়করার গণতন্ত্র ও সংবিধান কার দরকার?
ফাটল, ফাটল কেবল চারদিকে: লীগ যদি গোপালগঞ্জি ছাড়া ভরসা না পায়, বিএনপি যদি বগুড়াবাসী ছাড়া আর সবাইকে অবিশ্বাস করে, তাহলে কী করে তারা জাতীয় দল হয়? এমন অঞ্চল-অন্ধত্ব নিয়ে কী করে দেশের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব? ইংরেজের খলবুদ্ধিতে ভারত বিভক্ত হয়। এখন কার বুদ্ধিতে জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানো হচ্ছে? শুনি দেশ স্বাধীন এবং দলগুলো গণতান্ত্রিক! তাহলে কাবিলা-সংস্কৃতি চলে কী করে?
অনৈক্যের এই পরিস্থিতি অনেকের কাছে সামাজিক সন্ত্রাসের জন্য মওকা এনে দিয়েছে। সাঁথিয়ায় ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ধোঁয়াটে অভিযোগে হিন্দুসমাজের মানুষের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা হয়েছে। সেই ফেসবুক, সেই গুজব, সেই প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, সেই অচেনা লোকদের চালানো তাণ্ডব। রামু আর সাঁথিয়ার হামলার ছক হুবহু এক। সেই ঘটনায়ও দ্বিদলীয় দোষাদুষির ঢলে সত্য ভেসে গেছে। যখন সত্য জানা যায় না, তখন জনশত্রুরা অপার ক্ষমতাধর হয়ে পড়ে।
রামু থেকে সাঁথিয়া: ধর্মীয় সহাবস্থানের জমিতে একেকটি ফাটল এবংফাটলগুলো বোজানোর বদলেবাড়ানো হচ্ছে। কল্পিত অভিযোগে ইসলামের যতটা না অবমাননা হলো, তার থেকে বেশি অবমাননা ও সমালোচনা জুটল দাঙ্গাবাজদের আচরণে। রামুর মতো এবারও সরকার দোষারোপ করছে বিরোধী দলকে, বিরোধী দল দেখাতে চাইছে সরকারি ষড়যন্ত্রের আলামত। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক ফাটল, ধর্মকে কেন্দ্র করে সামাজিক ফাটলের পর আশা তাহলে থাকল কোথায়? এত ফাটল, এত বিভাজন নিয়ে কীভাবে চলবে এই দেশ?
সেই মানুষেরা কোথায়: মুসলমান সমাজকে ‘অপরাধী’ ও ‘লজ্জিত’ করে হিন্দুসমাজকে বিপন্ন করায় নাগরিক সংহতিতে যে ফাটল ধরে, তাতে কার লাভ? ‘সংখ্যালঘু’ বনাম ‘সংখ্যাগুরু’র গণিতকে রাজনীতির পাশা খেলায় বাজি রাখার এই নির্বাচনী রাজনীতি নিজেই কি সাম্প্রদায়িকতার জনক নয়, দেশভাগের কারিকাশক্তি নয়? এই নির্বাচনী গণিত এখনো উপমহাদেশে ‘সংখ্যালঘুত্বকে’ আক্রমণের সহজ শিকার করে রেখেছে। ভয় হয়, নির্বাচনী ডামাডোলের সুবিধার্থে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। এ রকম পরিস্থিতিতে ঘটনার সত্য আর জড়িত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ চেইনটা উন্মোচন করা ছাড়া সমস্যার গোড়া ধরা যাবে না। যখন ক্ষমতা মিথ্যা বলে তখন সত্যকে আলিঙ্গন করার দায়জনগণের।
তবু ফাটল বোজানোর মতো মানুষ থাকে। রামুর ঘটনায় স্থানীয় একদল যুবক রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সাঁথিয়ায় বাবলু সাহাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন বাজারের সহ-ব্যবসায়ীরা। সময়ের প্রয়োজনে সামান্য মানুষও অসামান্য হয়ে ওঠেন। আজ আমাদের সেসব মানুষকে বড় প্রয়োজন, যাঁদের বাড়ি যে জেলাতেই হোক, যে দলের বা যে ধর্মসমাজের সদস্য তাঁরা হোন না কেন, বাংলাদেশের বিপদটা তাঁরা বোঝেন। সেই মানুষ খুঁজি যাঁরা একজন হলেও রুখে দাঁড়ান আর তাঁদের ডাকে কমপক্ষে দশজন লোক দাঁড়িয়ে যায়। আপনি কি তিনি? আপনার চারপাশে আরও দশজনকে কি আপনি ডাকছেন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]