শুভবুদ্ধির জাগরণ চাই

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করছে। বলা হয়ে থাকে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়। তবে দেখা গেছে, সর্বাত্মক ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিস্থিতি শোচনীয় হয়। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের মর্মান্তিক হত্যা ও অপর তিনজনের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাতে সমগ্র জাতি স্তম্ভিত, শোকার্ত। দীপনের বাবা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত একজন শিক্ষক, একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে চরম শোকের মুহূর্তেও অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ মত ব্যক্ত করেছেন। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না, হত্যাকারীদের শুভবুদ্ধির জাগরণ চাই।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি আইনে বিশ্বাস করি, তাই মামলা করব, কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ড নিছক ধর্মীয় বিষয় নয়, এর পেছনে আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে।’ এ সময় তাঁর শোকার্ত চেহারার আড়ালে একজন রক্ত-মাংসের বাবার মর্মান্তিক যন্ত্রণা ঢাকা থাকেনি। প্রত্যেক সংবেদনশীল মানুষ এই শোকার্ত বাবার সমব্যথী হয়েছেন। কিন্তু কী বললেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালনকারী মাহবুব উল আলম হানিফ? তিনি তাঁকে উপহাস করলেন, প্রতিপক্ষ বানালেন?
একজন শোকার্ত বাবার ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তে উচ্চারিত বক্তব্যের গভীরতা বোঝার ক্ষমতা ক্ষমতায় থাকা মানুষের না-ও থাকতে পারে। কেননা, এই অবস্থায় অনেকেই কেবল ক্ষমতার বিচারেই পক্ষ-প্রতিপক্ষ হিসেবে পৃথিবীকে দেখতে জানেন। দৃষ্টি ও বিবেচনাশক্তিকে আরও একটু প্রসারিত করে এর নিকট ও সুদূরপ্রসারী কুশীলবদের দেখার মতো ক্ষমতা তাঁরা হারিয়ে ফেলেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর বক্তব্য যেকোনো সংবেদনশীল মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এর ধাক্কা লাগবে আওয়ামী লীগের গায়ে। এসব গায়ে না মাখলে আখেরে দলের ও দেশেরও ক্ষতি। তাই শোকের পাশাপাশি সচেতন মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বেড়ে যায়।
যারা দীপনের মতো মুক্তমনা মানুষদের হত্যাযজ্ঞে নেমেছে, তারা কেবল বাংলাদেশে তৎপর তা নয়, ধর্মান্ধ মানুষের তৎপরতা ভারত-পাকিস্তানে যেমন আছে, আছে মধ্যপ্রাচ্যে-আফ্রিকায়, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাদের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ধরনের চরমপন্থী মতাদর্শের উত্থানের সময় এবং তৎপরতার ক্ষেত্রগুলো বিচার করলে এর পেছনের উদ্দেশ্য আমরা বুঝতে পারব। সেই সূত্রে স্মরণ করিয়ে দেব মধ্যপ্রাচ্যে কৃত্রিমভাবে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা এবং সৌদি আরবের বর্তমান রাজবংশকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে তৎকালীন ইঙ্গ-যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকার কথা।
এমনকি এই সেদিন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ভাঙার সূচনাকর্মটির ক্ষেত্র হিসেবে পোল্যান্ডকে বাছাই করা, সে দেশের একজন বন্দরশ্রমিক ওয়ালেসাকে নায়ক বানানো (আজ তিনি বিস্মৃত) এবং এই সময়ে পোলিশ বংশোদ্ভূত একজনকে পোপ বানিয়ে দূতিয়ালির কাজে লাগানোর গভীর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথাও স্মরণ করা যায়। এসবই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির চাল। তারা যেকোনো মূল্যে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি থাকতে চায়।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন কাজ হয়নি। ইরান ও ভারতের মধ্যবর্তী ও চীনের নিকট প্রতিবেশী এই পাহাড়ি দেশটির রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে কী করল? জঙ্গি ইসলামি তালেবানদের সমর্থন দিল, তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে শক্তিশালী করে তুলল। পরবর্তীকালে মুসলিম-অধ্যুষিত বিরাট অঞ্চলজুড়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর জন্য তারা আল-কায়েদা সৃষ্টি করল। একসময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির অবসান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদারির কাল শুরু হলো। গোত্রভিত্তিক সমাজটিতে অস্থিরতা দেখা দিল এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লিপ্ত সে দেশে এখনো শান্তি আসেনি, মুসলমানরা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে ব্যস্ত রয়েছে।
জজিরাতুল আরবে সৌদি বংশকে ক্ষমতায় বসিয়ে সাম্রাজ্যবাদ মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের দখল নিয়েছে। কে না জানে এসব রাজা-বাদশাহ ইসলামসম্মত জীবনাদর্শের পরিপন্থী ভোগবিলাসের জীবনেই অভ্যস্ত। তদুপরি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার তাঁবেদার আরও রাষ্ট্র সৃষ্টির ব্যাপারে তারা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে থাকে। আরব-ইসরায়েল কোনো যুদ্ধেই সৌদি আরব অংশ নেয়নি। কিন্তু আরব বিশ্বের দুই স্বাধীনচেতা শাসক ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তার আগ্রাসী বাহিনীকে সব রকম সহযোগিতা দিয়েছে সৌদি সরকার। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র সিরিয়া ছাড়া সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র বলয়ের বাইরে আর কোনো দেশ নেই। তাই ঠিক ইরাকের মতোই এখানেও শাসক পরিবর্তনের ধুয়া তুলেছে তারা। ঠিক আগের মতোই সৌদি আরব রয়েছে তাদের পাশে। ইরাক থেকে সিরিয়ায় অস্থিরতা নৃশংসতায় লিপ্ত জঙ্গি ইসলামি দল আইএস বা আইসিস সবই একসুতোয় গাঁথা।
ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের আদি উদ্গাতা কারা? বহুকাল ধরে আমাদের দেশের আলেম-মাওলানারা ওয়াহাবি পন্থা ও মওদুদিবাদীদের ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে এসেছেন। কারণ, এঁরা ইসলামের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা হাজির করে দেশে অনেককাল ধরেই অস্থিরতা সৃষ্টির কাজ করেছেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার কারণে বিচারে মওদুদির ফাঁসির রায় হয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সে আদেশ মওকুফ হয়েছিল। একইভাবে তারা এ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিরোধিতা করে ক্ষান্ত হয়নি, পাকিস্তান সরকারের দোসর হিসেবে পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় দেশের চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। সেই সময়ও দখলদার পাকিস্তান সরকারকে মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখনো পরাজিত এই শক্তি বাঙালি মুসলমানদের চিরায়ত মানবিক ধর্মসাধনার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথে অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে আখেরে কার লাভ? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এতে বিএনপি লাভবান হবে। কিন্তু কার্যত আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার সূত্রে তখন সব ধারার ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তৎপর হয়ে এক হবে এবং তারা ক্ষমতার অংশীদার হবে এবং কিছুকালের মধ্যেই ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। যেহেতু ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের মধ্যে মতপার্থক্য তীব্র এবং তারা যেহেতু গণতান্ত্রিক কোনো মূল্যবোধেই বিশ্বাস করে না, তাই তাদের মধ্যে পরস্পর ব্যাপক সংঘাত অনিবার্য, যা ইরাক, আফগানিস্তানসহ মুসলিম দেশে দেশে চলছে। বিএনপি এই দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে ব্যর্থ হবে এবং দেশ চরম অস্থিরতা ও নৈরাজ্যে আবর্তিত হবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের পরিণতি কী হয়—একনায়ক, নয় তো নৈরাজ্য?
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আকারে ছোট হলেও এর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সামরিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশটির ভূমিকা হতে পারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই আমরা দেখি, এ দেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে চীন-জাপানে প্রতিযোগিতা, ভারতের আগ্রহ, সহায়তার প্রতিযোগিতায় বিশ্বব্যাংকও এগিয়ে আসছে, যার অর্থ পশ্চিমও তাদের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছে এখানে। যুক্তরাষ্ট্র অনেক রকম চুক্তিতে আমাদের আবদ্ধ রাখতে চায়, নানা সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে আমাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে।
বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্কে আমরা তো জড়িয়ে আছিই। ফলে অস্থিরতার সুযোগ নেওয়ার পক্ষ রয়েছে অনেক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুসলিম দেশে ইসলামের জঙ্গি ব্যাখ্যা হাজির করে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপশক্তির অভাব কখনো হয় না। মনে হয় এরা ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় সাহিত্যের মর্ম উপলব্ধি করে পাঠ করে না। ফলে শক্তিশালী চতুর স্বার্থান্বেষীর দল এদের ব্যবহার করে নিজেদের সুদূরপ্রসারী স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশে অতীতে এরা পারেনি। আমাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং ক্রমাগত অসহিষ্ণু দ্বন্দ্বের কারণে সমাজের অভ্যন্তরে নীরব প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এরা ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি করতে পেরেছে। তাতে রাজনৈতিক সংকট গভীর হয়েছে। এরা এই সংকটের সদ্ব্যবহার করে তলেতলে শক্তি সঞ্চয় করে এখন আঘাত করে চলেছে। এ সময়ে অতীতের মতোই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণ দরকার এবং সেই সঙ্গে প্রকৃত আলেম-ওলামাদের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
গুপ্তহত্যার ঘটনা ইসলামকে নিচে নামাচ্ছে। কারণ, ইসলাম নিশ্চয় এমন ধর্ম নয়, যা যুক্তির যুদ্ধে বিজয়ী হতে অক্ষম, যে ধর্মে অসির চেয়ে মসি এবং শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালি শক্তিশালী ও পবিত্র বলা হয়েছে, সে ধর্ম কি জ্ঞান ও লেখনীর লড়াইয়ে অসমর্থ? মুসলিম সমাজ কি কাপুরুষের আচরণ চিনতে অপারগ? আর যা-ই হোক, ইসলাম কাপুরুষদের ধর্ম নয়, এসব ঘটনা এ ধর্মকে কলুষিত করছে। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্মমোহ’ কবিতার কথা মনে পড়ছে—
‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
....
বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে,’
ধর্মের মোহজালে জড়িয়ে এরা নিজে মরে, অন্যকে মারে এবং বারংবার নিজের ধর্মকেই অপমান করে যায়। শেষ দুই পঙ্ক্তিতে কবি বলেছেন:
‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’
কীভাবে জ্ঞানের আলোক আনব? ক্ষমতায় বসে কেবল বিএনপির ছায়া দেখে আঁতকে উঠলে হবে? আর শোকার্ত মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর বাক্য উচ্চারণ করলে চলবে? আমি মনে করি, সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনায় সম্পন্ন সামাজিক জাগরণ আজ অগ্রাধিকার পাওয়া দরকার। রাজনীতিকে সেটারই সহযোগী হয়ে পরিশুদ্ধ হতে হবে। তবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের অভীষ্ট এমন এক মানবিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম করতে সক্ষম হব, যেখানে ইসলাম ও অন্য সব ধর্ম ও মত মর্যাদার সঙ্গে বিকশিত হতে সক্ষম হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।