পুনশ্চ অভিবাসন

অনেক আগে গল্প শুনেছিলাম: হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত এক ছেলেকে কয়েকটি রোগের নাম বলতে বলা হয়েছিল। তো সে শুরু করেছিল এভাবে: ‘কলেরা, টাইফয়েড, জ্বর, কাশি’। কিন্তু ‘কাশি’ বলতেই তার মন চলে গেল তাদের তীর্থস্থান ‘কাশী’তে। অতএব, অতঃপর সে ক্রমান্বয়ে বলে যেতে লাগল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানগুলোর নাম।
তা আমিও আমার এই কলামে গত কিস্তির লেখায় প্রায় অনুরূপ একটি কাণ্ড করে ফেলেছি। অভিবাসী সমস্যাটি নিয়ে ইদানীং ইউরোপে তোলপাড় চলছে, জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে হাজার হাজার মানুষ দাঙ্গা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। আমি শুরু করেছিলাম এটা নিয়ে একটা সরস নিবন্ধ লিখতে; কিন্তু শেষাবধি সেটা হয়ে গিয়েছিল আমেরিকায় আমাদের দেশের লোকদের অভিবাসন–সম্পর্কিত একটি কড়চা, যেহেতু ইদানীং আমাদের দেশ থেকে প্রচুর ‘এমিগ্রেন্ট’ প্রতিনিয়ত ‘ইমিগ্রান্ট’ হয়ে আমেরিকায় যাচ্ছেন।
যাহোক, এ দেশের গ্রামাঞ্চলে একসময় স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে ডিঙিয়ে যাওয়া একটা গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হতো, বর্তমানের হাল-হকিকত জানি না। তো গল্প আছে, একবার এক কৃষকের বউ রাতে শোবার সময় স্বামীকে ডিঙিয়ে গেলে স্বামী ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ‘এটা তুমি কী করলে?’ বধূটি ঝটপট উত্তর দিয়েছিল, ‘ঠিক আছে, এখনই সেটা শুধরে নিচ্ছি’। এটা বলেই সে পুনরায় স্বামীকে ডিঙাল। তদ্রূপ আমিও ‘পুনশ্চ অভিবাসন’ লিখে ব্যাপারটা শুধরে নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছি বৈকি।
শুরুতেই কিছু পরিসংখ্যান। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু-বিষয়ক হাইকমিশনের মতে, ইউরোপে সম্প্রতি সমাগত অভিবাসন-প্রত্যাশীদের প্রতি ১০ জনের আটজনই সিরিয়ার নাগরিক। আফগানিস্তানের নাগরিক শতকরা ১০ ভাগ আর ইরাকের নাগরিক হচ্ছে শতকরা ৩ ভাগ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম চার মাসেই ৫১ হাজার মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এ সময়ে সাগরে ডুবে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার ৮০০ জন এবং ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীদের ডুবে মরার সংবাদ প্রায় প্রতিদিনই আসছে।
মানলাম, পূর্ব আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইমিগ্রান্টদের যে স্রোত ইউরোপে যাচ্ছে, তা সেখানকার কয়েকটি দেশে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিষয়টার সঙ্গে মানবিক প্রশ্ন জড়িত বিধায় এটাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা উচিত। ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রনায়ক সেভাবে দেখছেনও। যেমন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল আট লাখ অভিবাসন-প্রত্যাশীকে জায়গা দেওয়ার কথা বলেছেন। আমার কেন জানি মনে হয়, এ ক্ষেত্রে শাশ্বত মাতৃত্ব আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মানির নৃশংসতাজনিত অপরাধবোধ কিছুটা হলেও কাজ করেছে। বিলেতে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরিকালে আমি যখন একজন ইংরেজ মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের পূর্বপুরুষ যে সারা দুনিয়ায় কলোনি স্থাপন করে শাসন ও শোষণ করে বেড়িয়েছেন, সে সম্পর্কে তার মতামত কী। তখন মেয়েটি বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে জবাব দিয়েছিল, ‘আমি মনে করি ওঁরা ছিলেন লোভী।’ বলাবাহুল্য, মেয়েটির কথাটা আমার খুবই মনে ধরেছিল। আর বোধ করি এমন চিন্তাধারার ফলেই ব্রিটিশরা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো থেকে আগত অভিবাসীদের প্রতি বহুলাংশে উদার। তা নইলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা সাংসদ বা রাষ্ট্রদূত হতে পারতেন না।

>ইউরোপের আরেকটি দেশ পোল্যান্ড শুধু খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের নিতে চায়। তা ইউরোপে পোলিশদের বোকামির গল্প নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার লোকের অভাব নেই

চলমান অভিবাসন সংকটের প্রতি কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশের প্রতিক্রিয়াও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। হাঙ্গেরি তো অতি সম্প্রতি আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দিয়েছে যে সে দেশের অধিবাসীরা অত্যন্ত অতিথিবৎসল, তবে তেনারা বেআইনিভাবে প্রবেশকারী কোনো অভিবাসন-প্রত্যাশীকে আশ্রয় দেবেন না। এটা অনেকটা সেই গল্পের মতো আরকি: বৃদ্ধ ভদ্রলোক তরুণী ভার্যাকে বাড়িতে নিয়ে এসে বললেন, ‘আমিসুদ্ধ এই বাড়ির সবকিছুর মালিক তুমি; তবে চাবির গোছাটা আমার কাছে থাকবে।’
ইউরোপের আরেকটি দেশ পোল্যান্ড শুধু খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের নিতে চায়। তা ইউরোপে পোলিশদের বোকামির গল্প নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার লোকের অভাব নেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর এক লেখায় পড়েছিলাম, শ্মশ্রুহীন পোলিশ যুবক পোলডিকে রাস্তায় থামিয়ে আরেক শ্মশ্রুমণ্ডিত যুবক যখন বলল, ‘আমাকে চিনতে পারলে না, আমরা একসঙ্গে প্রাইমারিতে পড়তাম’, তখন সে সরোষে প্রত্যুত্তর করল, ‘বাজে বকবেন না; দাড়িওয়ালা কেউ প্রাইমারিতে আমার সঙ্গে পড়ত না।’ আর তার স্ত্রী বাজার থেকে নখের পলিশ সরানোর জন্য ‘পলিশ রিমুভার’ কিনে নিয়ে এলে সে ভাবল, তার বউ বুঝি তাকে পৃথিবী থেকে সরানোর জন্য ওটা নিয়ে এসেছে।
বারান্তরে পোলিশ যুবক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ডিটেকটিভের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলে তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘যিশুখ্রিষ্টকে কে বা কারা মেরেছে’, তখন সে নিশ্চুপ থাকায় প্রশ্নকর্তা চেয়ারম্যান বললেন, ‘বাড়িতে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে আগামীকাল এসে আমাকে বলবেন’। সে নিশ্চিন্তমনে বাড়ি ফিরে বউকে বলল, ‘জানো, আমার চাকরি হয়ে গেছে এবং প্রথম দিনেই আমাকে একটা মার্ডার কেস তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
এহেন ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’ না হলে কি ওরা খোলাখুলিভাবে বলে, ‘আমরা কেবল খ্রিষ্টানদের নেব?’
যাহোক, অভিবাসন ও পোলিশদের নিয়ে আইজাক আসিমভ, যিনি নিজেও ছিলেন একজন অভিবাসী, তাঁর ট্রেজারি অব হিউমার গ্রন্থে যে গল্পটি সন্নিবেশিত করেছেন, সেটি পরিশেষে পরিবেশন করে আপাতত বিদায় নিতে চাই। অর্ধশতাব্দীরও অধিক কাল আগে, যখন আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের ব্যাপারে এত কড়াকড়ি ছিল না, পূর্ব ইউরোপ থেকে একদল অভিবাসন-প্রত্যাশী জাহাজ বোঝাই হয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে মাঝপথে হঠাৎ জাহাজটি প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে যায় এবং জাহাজ পরিত্যাগের প্রশ্ন দেখা দেয়। অতঃপর জাহাজের ভেতরে অবিশ্বাস্য রকমের গোলমালের সৃষ্টি হয়। বাচ্চাদের চিৎকার, মহিলাদের কান্নাকাটি, পুরুষদের হাঁকডাক ও দৌড়াদৌড়ি, শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য নাবিকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা—সব মিলিয়ে যেন এক নারকীয় অবস্থা। যতগুলো সম্ভব লাইফবোটও লাইনআপ করা হলো। এত সব হইচইয়ের মধ্যে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ থেকে আগত এক লোক শান্ত-চুপচাপ বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছিল। তার এক বন্ধু দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলল, ‘আংকেল, আংকেল! তুমি এত নির্বিকার বসে আছ কেমন করে? জাহাজ ডুবে যাচ্ছে। ওটা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছে!’
‘তাতে কী হয়েছে?’ আংকেল বলে উঠল, ‘জাহাজটা তো আমার সম্পত্তি নয়।’
পাদটীকা: সব পাখি নীড়ে ফেরে, সব অমানিশারও অবসান হয়।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷