বিষচক্রের ফাঁদে বাংলাদেশ

তুলি
তুলি

দুই ধরনের বিষচক্রের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। দুটি চক্র আবার নানাভাবে পরস্পর যুক্ত। একটি চক্র দেখা যায় প্রধানত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, অন্যটি রাজনৈতিক বলয়ে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিষচক্র হলো: চুরি-দুর্নীতি-দখল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা, সেখান থেকে আরও দখল-চুরি-দুর্নীতি, এ থেকে আরও বড় ক্ষমতার প্রভাব, সেখান থেকে চুক্তি কমিশন, তা থেকে চোরাই টাকা, আরও দখল-লুণ্ঠনের ক্ষমতা ইত্যাদি। এটি চক্র হলেও একই বৃত্তে আটকে থাকে না। ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে থাকে এবং আরও বেশি মাত্রায় লুট ও বড় রাজনৈতিক ক্ষমতা একাকার করে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এখান থেকেই জন্ম হয় চোরাই টাকা (প্রচলিত ভাষায় কালোটাকা), গোপন সাম্রাজ্য আর প্রকাশ্য ক্ষমতার। এই চোরাই টাকা আবার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ক্রমে ক্ষুধা বাড়ে, দখলের প্রয়োজন বাড়ে। ফলে এদের দখলের আওতা শুধু গরিব মানুষের ঘর বা ক্ষুদ্র কৃষকের জমিতে আটকে থাকে না; নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বন—সবকিছুই ক্রমে তাদের খাদ্যে পরিণত হয়।
ইউরোপের পুঁজিপতি শ্রেণীর উদ্ভবের আদিকাল বিশ্লেষণ করে কার্ল মার্ক্স যথার্থই দেখিয়েছিলেন যে দস্যুতা, লুণ্ঠন, দখলই ছিল পুঁজির আদি গঠনের মূল ভিত্তি। এই পর্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পর্বের মিল আছে। তবে ইউরোপের উদীয়মান ধনিক শ্রেণী উপনিবেশগুলোকেই সম্পদের উৎস হিসেবে ব্যবহার করত, তার জন্য বর্বরতার অনেক স্বাক্ষর তারা রেখেছে। তারা সেই সম্পদ জমা করেছে, ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে, স্বদেশকেই তারা তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের গন্তব্য হিসেবে গণ্য করেছে। ফলে সেখানে রাজনৈতিক সক্ষমতা সেভাবে বিকশিত হয়েছে। আর বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো। এ দেশের এই শ্রেণী বাংলাদেশকে বিবেচনা করছে উপনিবেশ হিসেবে, নিজেদের সম্পদ আহরণ, টাকা বানানোর ক্ষেত্র হিসেবে। এবং তার উদ্বৃত্ত তারা জমা করছে ভিনদেশে, ভিনদেশকেই তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ মনে করছে। সে কারণে এখানে প্রতিষ্ঠান ও সক্ষমতা গড়ে তোলার তাগিদ এদের নেই। মূলধারায় রাজনীতির চরিত্রও তাই জমি দখলের সংঘাতের ওপরে উঠতে পারেনি। বিশ্বপুঁজি সারা পৃথিবীতে দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ, দখল ও ধ্বংসের পাশাপাশি যে ‘নয়া উদারতাবাদের’ বিষচর্চা করছে, ডেভিড হার্ভের ভাষায় যা বিশ্বজুড়ে ‘একুমুলেশন বাই ডিসপজিশন’ ঘটাচ্ছে, সেই নীতিমালা এ দেশের চোরাই টাকার সঞ্চয়নের পথ তৈরিতে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে।
দেশ দেশ নয়, জমিদারি; দখলে রাখতেই হবে। যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে বা থাকতেই হবে। কেননা, তার সঙ্গে যুক্ত বিশাল চোরাই টাকা আর বিত্তবৈভবের নিরাপত্তা। এর সঙ্গেই যুক্ত রাজনৈতিক বিষচক্র: এক দল ক্ষমতায় আসে, তাদের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য দলকে ক্ষমতায় আনে। এখানেও বিষচক্র ঊর্ধ্বমুখী। যত দিন যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা, নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড, লুটমুখী নীতিমালা আর দুর্নীতি বাড়তে থাকে।
দুটি বিষয় বাংলাদেশে বহু আগেই ফয়সালা হয়ে যাওয়ার কথা। এর একটি হলো যুদ্ধাপরাধীর বিচার, আরেকটি হলো মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া। ৪২ বছরেও এর ফয়সালা হয়নি, বরং দেশকে সংঘাতসংকুল করেছে, টেনে রেখেছে পেছনে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। দলীয়করণের জালে প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, সর্বজন প্রতিষ্ঠান—সবই নিম্নগামী। তবে যত সংঘাত আর অস্থিতিশীলতাই থাকুক, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের ঊর্ধ্বমুখী বিষচক্রের শক্তি বৃদ্ধিতে তা বাধা হয়নি, বরং সহায়কই হয়েছে। কেননা, মানুষের চিন্তার জগৎ দুই দলের বিভক্তিকে মুখ্য ধরে চর্চিত হয়েছে, তাদের ঐক্যের জায়গা মনোযোগের আড়ালেই থেকেছে বরাবর। এই ঐক্য জনগণের বৃহৎ অংশকে চোখে ঠুলি দিয়ে, তার ওপর ভর করে স্বার্থ রক্ষা করছে লুটেরা দখলদারদের। এই ঐক্য সমাজে হীনম্মন্যতা তৈরি করে দেশকে ভিনরাষ্ট্রের বা বহুজাতিক পুঁজির আধিপত্যের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এই ঐক্য নিপীড়কের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহারের রাজনীতির বিকাশ ঘটিয়েছে, সাম্প্রদায়িকতা ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা বেড়েছে।
উন্নয়নের নামে বাংলাদেশে সর্বজনের চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়েছে, ব্যয়বহুল মুনাফাসন্ধানী চিকিৎসা ব্যবসার বিস্তার ঘটেছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, কনসালট্যান্ট ও এনজিও কর্মকর্তারা যেকোনো ধরনের অসুখে, এমনকি মেডিকেল চেকআপ করাতে ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও যুক্তরাষ্ট্রে দৌড় দেন। একটি স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে এ জন্য কি লজ্জিত হওয়ার কথা নয়? এ দেশে বড় শপিং মল হয়, কিন্তু পাবলিক বা সর্বজনের বৃহৎ হাসপাতাল হয় না। শিক্ষাও ব্যয়বহুল হয়েছে ক্রমান্বয়ে, ব্যক্তিমালিকানা বাজার ও মুনাফামুখী হওয়ার কারণে। পাবলিক বা সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষমতাসীনদের মাঠ দখল আর দলীয় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বানানো হয়েছে। দেশের কত অভুক্ত পরিবারের মানুষ তাদের সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে চায়। তাদের জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যারা শিক্ষাকে এভাবে বিলাসী পণ্যে রূপান্তর করল, তাদের অনেকের সন্তানকে বিশ্বের খুবই ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানে, দেশ থেকে পাঠানো টাকায়, ডিগ্রি নিতে দেখা যায়।
দেশ থেকে লুটের টাকা নিয়ে যারা বাইরে গিয়ে শানশওকত প্রদর্শন করে, তাদের ধারণা নেই, সেই সব দেশে তারা কী রকম অবজ্ঞা ও করুণার পাত্র। ধারণা করি, দেশেও বাংলাদেশের নেতা আর ধনী বাহাদুরদের নিয়ে বিভিন্ন দূতাবাস, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানি অফিসে হাসাহাসি হয়। কত কম টাকায় কিনে ফেলা যায় নেতা, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের! কীভাবে ব্যবসায়ীদের জুনিয়র পার্টনার বানিয়ে বৃহৎ দখলে মহানন্দে এগিয়ে যাওয়া যায়। বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানির এক সিইও স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘এখানে ঘুষ দিতে হয়, কিন্তু কাজের জটিলতা অনেক কম। তাদের মুনাফার হার অনেক বেশি, বেতন ও মুনাফা খুব সহজে দেশে পাঠাতে পারেন’ (বণিক বার্তা, ২ নভেম্বর, ২০১৩)। সামান্য কিছু (লাখ বা কোটি) টাকার বিনিময়ে এ দেশের অমূল্য সম্পদ তো বটেই, এমনকি দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব অন্যের হাতে তুলে দিতে, দেশের মানুষের বহু প্রজন্মকে বোঝা, সংকট, বিপদ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলতে এই টাকাখোর ক্ষমতাবানদের যে হাত কাঁপে না, তার প্রমাণ বহু।
সে জন্য যখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই পক্ষ আস্তিন গুটিয়ে রক্তারক্তিতে নেমে মানুষের অতিষ্ঠ জীবন আরও দুর্বিষহ করছে, তখন ঠিকই দুই পক্ষের ঐকমত্যের কাজগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারসহ নানা প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা লুট ও পাচারে বাধা নেই। পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নিয়ে প্রতারণা অব্যাহত। রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের খবর নেই। যে জিএম খাদ্য (বিটি বেগুন) পশ্চিমে তো বটেই, ভারতেও নানা বাধার মুখে, তা সরকার পাস করে দিচ্ছে। বিদ্যুৎকে ব্যবসাপণ্য বানানোর প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পিএসসি ২০১২ সংশোধন করে দরপত্র আহ্বানের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে, সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করার আয়োজনের মধ্যে জমি দখলের উৎসবে মেতেছে নানা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। ফুলবাড়ীর মাটি-পানি-মানুষবিনাশী দেশবিরোধী প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই দলের নেতাদেরই ঐক্যবদ্ধ তৎপরতার দেনদরবার চলছে!
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়া তাদের স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চাইছে। সেখানে তাদের ঐক্য ও বিরোধ—দুটোই আছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ভাগ্য ঠিক করতে। নানা তৎপরতা থেকে মনে হচ্ছে, ক্ষমতা নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত দুই জোটের কে তাদের কত সুবিধা দিতে পারে, তা নিয়ে পর্দার পেছনে প্রতিযোগিতা চলছে। সামনে চলছে নির্বাচন আর সংঘাতের নিষ্ঠুর খেলা। থলে থেকে চোরাই টাকা বের হচ্ছে, জেল থেকে বের হচ্ছে কিংবা গোপন প্রবাস থেকে ফেরত আসছে সন্ত্রাসীরা, অস্ত্র জমা হচ্ছে নানা জায়গায়, কমিশন খেয়ে নির্বাচনের তহবিল তৈরি হচ্ছে, বিনিময়ে সর্বনাশা প্রতিশ্রুতি।
হাসিনা-খালেদার সংলাপ আর ঐক্য নিয়ে বিস্তর আগ্রহ তৈরি করেছে ‘সুশীল সমাজ’ ও মিডিয়া; যেন সংঘাত ও ঐক্য নিছক এই দুই ব্যক্তির বিষয়। ‘দুই নারীর কারণেই সমস্যা’—এ রকম প্রচারণায় সমাজে নারী নেতৃত্ববিরোধী, নারীবিদ্বেষী প্রচারণা চিন্তা, ধ্যান-ধারণাও পুষ্ট হয়। এই দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ চলছে ১৯৯১ সাল থেকে। কিন্তু এঁরাই কি দেশ চালাচ্ছেন? তাঁদের চারপাশে তো একদঙ্গল পুরুষই আছে। বরং এই নেতৃত্ব নারী হওয়ার কারণে একটা ভণ্ড প্রতারণার হাত থেকে দেশ বেঁচেছে। এরশাদের মতো ধর্মকে নিয়ে যথেচ্ছাচার তাঁরা করতে পারেননি, নারী হওয়ার কারণেই। আর বাকি সবই, তাঁদের রাজনীতির একজন পুরুষ নেতা হলে যা করতেন, তা-ই তাঁরা করেছেন।
অচিরেই নির্বাচন হবে, এক বা দুবার। চোরাই টাকা, অস্ত্র, সন্ত্রাস আর ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার ঘটিয়ে বিষচক্রের নতুন পর্বে দেশকে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থশাস্ত্রে দারিদ্র্যের বিষচক্রের কথা আছে। এটাও আছে যে, এর থেকে বের হতে গেলে একটা বিগ পুশ দরকার। আমাদের দেশে এই দুই বিষচক্রের হাত থেকে মুক্তির জন্যও বিগ পুশ লাগবে। কিন্তু এর পূর্বশর্ত পূরণ হতে এখনো অনেক বাকি। জনগণের জীবন, তার মৌলিক অধিকার, তার সম্পদ কেড়ে নেওয়ার রাজনীতি আর ‘উন্নয়নের’ দড়িতে সমাজচৈতন্য এখনো বাঁধা। ঘোরে আচ্ছন্ন থেকে জনগণের বৃহৎ অংশ তার নিজের সর্বনাশের শক্তিকেই পুষ্ট করছে।
রাজনীতি ও উন্নয়ন সম্পর্কে সমাজে যে প্রতিষ্ঠিত বোধ, তার বদল না ঘটলে, জনগণের মধ্যে নিজের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা তৈরি না হলে, নিজের অন্তর্গত শক্তির উপলব্ধি তৈরি না হলে, দেশ ও দেশের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানার বোধ বিকশিত না হলে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হবে না। কিন্তু এই পরিবর্তন হতেই হবে। আজ যদি না হয়, তো কাল। না হলে এই বিষচক্র আরও বৃহৎ আকার নেবে। পুরো দেশ হজম হয়ে যাবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।