দেশটা শুধু রাজনীতিবিদদের নয়

কার্টুন-তুলি
কার্টুন-তুলি

রাজনীতি কি একটি পেশা? আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থে রাজনীতি পেশা নয়। তবে বাংলাদেশে প্রধান কয়েকটি দলের নেতাদের দিকে তাকালে মনে হতে পারে, ‘রাজনীতি’ করা তাঁদের পেশা। অন্তত তাঁদের জীবনের প্রধান সময় তাঁরা রাজনীতির জন্যই ব্যয় করেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁদের আয়ের একটা বড় অংশও রাজনীতির কারণেই আসছে। সত্যের খাতিরে বলতেই হবে, এমন অনেক রাজনীতিক রয়েছেন, তাঁরা যে আজ বিপুল অর্থ, বৈভব ও সম্পত্তির অধিকারী তা প্রধানত রাজনীতির জন্যই। অনেক ব্যবসায়ী তাঁদের মূল পেশা (ব্যবসা) ঠিক রেখে রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছেন। শুধু ঝোঁকেননি, তাঁরা তাঁদের ব্যবসাকে রাজনীতির জন্যই অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, যা নিছক ব্যবসায়ী হলে সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশে দু-তিনটি দলই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাকিরা শুধু দল। তাদের ভূমিকায় সরকার বা দেশের কোনো লাভ বা ক্ষতি হয় না। ‘কোয়ালিশন সরকার’ গঠনের প্রয়োজন হলে কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রধান দু-তিনটি দল দেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। মনে হয় তাদের হাতে পুরো দেশটা জিম্মি। এটা তারা পারছে কীভাবে? ভোটের জোরে। সংবিধানের জোরে। আমরা এমন একটা নির্বাচনপদ্ধতি মেনে নিয়েছি, যাতে একটি ভোট বেশি পেলেও একজন পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত ও আরেকজন পরাজিত হন। শুধু নির্বাচিত হলেও ক্ষতি ছিল না। নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে তাঁদের নিজের স্বার্থে, দলের স্বার্থে, গোষ্ঠীর স্বার্থে তাঁরা আইন তৈরি করছেন। পুরোনো আইন বাতিল করছেন। কিসের জোরে? নির্বাচনে ভোট বেশি পেয়েছিলেন বলে।
দেশ পরিচালিত হয় সংবিধান দ্বারা। প্রতিটি দেশের জন্য সংবিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই সংবিধান শুধু দল নয়, সরকার নয়; একজন ব্যক্তি তাঁর স্বার্থে, গোষ্ঠীর স্বার্থে পাল্টে ফেলতে পারেন। সেটাও ভোটের জোরে। অতীতেও এমন কাজ হয়েছে। কিছু রাজনীতিক ভোটের জোরে সংসদে বসে যা খুশি তা করছেন। করতে পারছেন।
এই রাজনীতিবিদেরা কি খুব বিদ্বান লোক? তাঁরা দেশের সবকিছু বোঝেন? দেশে আর কোনো বিদ্বান বা বিশেষজ্ঞ লোক নেই? বিদ্বান লোকেরা ভোটের খেলায় অংশ নেননি বলে তাঁদের জ্ঞান, মনীষা, অভিজ্ঞতা দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো কাজে লাগবে না? লাগানো হবে না? যাতে বিদ্বান লোকেরা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কোনো ভূমিকা পালন করতে না পারেন, তারও বিধান তৈরি করে রেখেছেন রাজনীতিবিদেরা। জাতীয় সংসদ ও সংবিধান (তাঁদের হাতে তৈরি) তাঁদের সেই ক্ষমতা দিয়েছে।
রাজনীতিকেরা দেশকে নিয়ে যা খুশি তা করছেন। দেশের কয়েক কোটি সচেতন, শিক্ষিত ও বিভিন্ন পেশার মানুষ তা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। কী অসহায় তাঁরা। কারণ, তাঁরা রাজনীতি করেন না। ভোটে প্রার্থী হন না। সেই পেশায় তাঁরা যাননি। আমাদের ধারণা, দেশের বহু শিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, সচেতন মানুষ কিছু রাজনীতিকের এই অন্যায় আচরণ ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় ক্ষুব্ধ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বা ঘটছে সেটাও এই বিভ্রান্ত, হঠকারী ও আত্মপ্রেমিক রাজনীতিকের কর্মকাণ্ডের ফল। দেশে আগুন জ্বলুক, মানুষের প্রাণহানি হোক, দেশের সম্পত্তি ধ্বংস হোক, তাতে তাঁদের কিছু এসে-যায় না। তাঁদের লক্ষ্য একটাই—‘গদিতে বসতে হবে’ বা ‘গদি কিছুতেই ছাড়ব না’। দুই পক্ষই এ জন্য নানা টালবাহানা ও ছলচাতুরী করছে। হরতালের মতো একটি নীরব প্রতিবাদ কর্মসূচিকে রাজনীতিকেরা সন্ত্রাসী কর্মসূচিতে পরিণত করেছেন।
দেশের মানুষ তা দেখছে। তারা অসহায়। রাজনীতিকেরা সব পেশার লোকের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। অন্যান্য পেশার কিছু লোক আবার এই রাজনীতিকদের খারাপ কাজে সমর্থনও দিচ্ছেন।
দেশে বর্তমানে যে সংকট চলছে, আশা করি তার একটা সমাধান হবে। কিন্তু এই সমস্যা যে আর কোনো দিন দেখা যাবে না, তা নয়। রাজনীতিকেরা দেশ নিয়ে যেন এভাবে ছিনিমিনি খেলতে না পারেন, তার জন্য কিছু নতুন আইন, নতুন বিধিবিধান তৈরি করার কথা ভাবতে হবে। যেমন নির্বাচনের বর্তমান চরিত্র বদলানোর জন্য ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ পদ্ধতি, ‘না ভোট’ চালু করা, জাতীয় সংসদে বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধি নিয়ে ‘দ্বিতীয় কক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার স্তরগুলোকে শক্তিশালী করা, দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি হতে না পারা, দুই টার্মের বেশি (সর্বমোট ছয় বছর) দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান (সর্বমোট ১০ বছর) হতে না পারা, পরিবারতন্ত্র বন্ধ করা ইত্যাদি বিষয়ে নতুন নতুন বিধিবিধান তৈরি ও সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন।
আমাদের সংবিধান আগাগোড়া পরিমার্জনা করার সময় এসেছে। এ জন্য বিরাট কর্মযজ্ঞ দরকার। এটা শুধু রাজনীতিকের কাজ নয়। ভোটে নির্বাচিত হলেই তারা জ্ঞান ও মনীষায় সমৃদ্ধ ব্যক্তি হবেন, এমন মনে করার কারণ নেই। কাজেই বিভিন্ন পেশার, বিশেষ করে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, জ্ঞান মনীষায় সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সংবিধান পরিমার্জনার কাজে যুক্ত করতে হবে।
নির্বাচনে জয়লাভ করে সংসদ সদস্যরা সংসদে বসে আইন প্রণয়ন করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার গঠন করবেন। এগুলো নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এগুলো সরকার পরিচালনার মূল শর্ত। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভ যাঁরা করবেন, পাঁচ বছর দেশ ও দেশের মানুষ তাঁদের কাছে জিম্মি হতে পারে না।
আবার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও অনেকে সংসদ অধিবেশনে যোগদান করেন না। অথচ ভাতা ও অন্য সুুবিধাদি নিয়ে থাকেন। এই পথও বন্ধ করতে হবে। যদি কোনো সংসদ সদস্য, যিনি একটি নির্বাচনী এলাকারই প্রতিনিধি, তিনি যদি মাসের পর মাস সংসদে না যান, তাহলে ওই এলাকার ভোটারদের ১০ শতাংশ ভোটার স্বাক্ষর করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে সেই সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করতে হবে। সেখানে নতুন করে ভোট হবে। ওই সংসদ সদস্য আর নির্বাচন করতে পারবেন না।
এ রকম আরও বহু পথ উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে নাগরিকদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারা শক্তিশালী হয়ে না যান। ভোটাররাই অর্থাৎ জনগণই দেশের মূল শক্তি ও দেশের মালিক। সেই জনগণকে আরও নানাভাবে ক্ষমতায়ন করতে হবে। ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ শুধু মুখে বললে হবে না। এর জন্য সংবিধানে নানা নির্দেশনা যোগ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড ও প্রকাশ করা নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক প্রত্যাশিত ও যৌক্তিক। ফোনালাপ বিনা অনুমতিতে রেকর্ড করা ও তা গণমাধ্যমে প্রচার করা গর্হিত অপরাধ হয়েছে। আইসিটি আইনে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তাদের আসামি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনের আশ্রয় নেবে বলে আশা করা যায়। ইতিমধ্যে কেউ কেউ এ ব্যাপারে মামলাও করেছেন। সেই মামলার পরিণতি কী হয়, তাও আমাদের দেখতে হবে।
অনেকে দাবি করেছেন: ‘এই ফোনালাপ প্রকাশ করা হয়েছে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। ফোনালাপের বিষয়বস্তু জনগণ জানতে আগ্রহী।’ তর্কের খাতিরে যদি এটা মেনেও নেওয়া যায়, তবু অনুমতির প্রশ্নটা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এখানে দুটি পক্ষ। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। দুজনেরই পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে ফোনালাপ রেকর্ড করা যেত। এ ক্ষেত্রে অনুমতি গ্রহণ করা হয়নি। দ্বিতীয় অপরাধ হলো: দুজনের অনুমতি ছাড়াই ফোনালাপের ভাষ্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। এটা দুই পক্ষের ব্যক্তিগত আলাপ। সংসদ অধিবেশনে বা জনসভার বক্তৃতা নয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো ফোনালাপ প্রকাশ করা গর্হিত অপরাধ।
মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের টেকনিক্যাল কারণে ও সরকার বা আদালত কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির ফোনালাপ রেকর্ড করে। এটা প্রশাসনিক, নিরাপত্তাজনিত ও বিচারিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে এর কোনোটাই সত্য ছিল না। তবু কোনো কারণে যদি এই ফোনালাপ রেকর্ড করা হয়েও থাকে (গুরুতর অপরাধ), তা গণমাধ্যমে প্রচার করার কোনো অধিকার কারও নেই। সংবিধান স্বীকৃত ব্যক্তিগত প্রাইভেসির এটা চূড়ান্ত লঙ্ঘন।
দীর্ঘ পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবারও সংসদে বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। প্রয়োজন মনে করলেন তখন, যখন দেয়ালে তাঁর পিঠ ঠেকে গেছে। তাঁর গদি নড়ে উঠেছে। আবার ক্ষমতায় যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। ‘ক্ষমতা’ এমনই এক মোহ। শেখ হাসিনা তাঁর সব জেদ ও একগুঁয়েমি ঝেড়ে বিরোধী দলের নেতাকে ফোন করেছেন। এসব নেতা ও দলের রাজনীতি কত স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদিতায় কণ্টকিত, শেখ হাসিনার ফোন করার ঘটনায় তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। যদিও এটা প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবু এর স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদিতার দিকটিও ভুলে গেলে চলবে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।