বিএনপির নেতাদের আটক

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করা হলো বিএনপির পাঁচ শীর্ষস্থানীয় নেতাকে। ফলে, তাদের পূর্বঘোষিত হরতালের দৈর্ঘ্য আরও ১২ ঘণ্টা বেড়ে গেল। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, আজ রোববার সকাল ছয়টা থেকে আগামী বুধবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত হরতাল। যে হরতাল ঠেকানোর জন্য গ্রেপ্তার, তার ফল হলো জনগণের আরও ভোগান্তি। তাই প্রশ্ন জাগে, এ ধরনের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকার কী অর্জন করতে চায়?
একদিকে আলোচনার আহ্বান, অন্যদিকে সম্ভাব্য আলোচনাসঙ্গীদের গ্রেপ্তারে সরকারের আচরণের স্ববিরোধিতাই ধরা পড়ল। মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, এম কে আনোয়ার, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও শিমুল বিশ্বাসের গ্রেপ্তারের কায়দাটাও শোভন ছিল না। প্রকাশ্য অনুষ্ঠান থেকে বেরোবার পথে সোনারগাঁও হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে যেভাবে প্রথম তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে মনে হয় সরকার তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বরং ফৌজদারি মামলার অপরাধী মনে করছে। অবশ্য যে মামলায় এই গ্রেপ্তার, তা ফৌজদারি চরিত্রেরই। সেই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার বাসভবন এবং গুলশান কার্যালয় ও নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চারপাশেও পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। নির্বাচন আয়োজনের প্রাক্কালে সরকারের এ রকম ‘হার্ড লাইন’ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিস্থিতির বদলে অস্থিতিশীলতারই ইঙ্গিত দেয়। জনগণ যখন সংকটের অবসান চাইছে, তখন এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘হরতাল করে মানুষ খুন ও মানুষ খুনের পরিকল্পনা করার’ অপরাধে বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ তাঁদের ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার জন্যও আদালতে আবেদন করেছে। রাজনৈতিক নেতারা হরতালের ঘোষণা দেন, তাঁদের সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে দলীয় কর্মীরা হরতাল বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এটা বলা যায় না যে তাঁরা সরাসরি হত্যা-নাশকতা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত। কর্মীদের যেকোনো কাজের জন্য নেতৃত্বকে নৈতিকভাবে দায়ী করা যায়, কিন্তু এক ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য অন্য ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যায় না। পাশাপাশি, বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের যেভাবে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে, তাতে মনে পড়ে যায় বিগত জরুরি অবস্থার সময় রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের কথা। এভাবে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ মামলা ও ধরপাকড় আশির দশকের স্বৈরতন্ত্রী আমলের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
সরকার একদিকে সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাদের আটক করছে। সুতরাং, এই গ্রেপ্তারের পেছনে কেবল সরকারের অসহিষ্ণুতাই নয়, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা থাকা সম্ভব। এবং সেই পরিকল্পনা যে আলোচনামুখী নয়, সেটাও ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিএনপিও এখন ‘মনের সুখে’ হরতাল দিয়ে যেতে পারবে।
এভাবে সমঝোতার সুযোগ নষ্ট করার পরিণতি যা-ই হোক, তার দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে।