সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিহার নির্মাণ

গৌতম বুদ্ধের শুভকামনা সবার জন্য
গৌতম বুদ্ধের শুভকামনা সবার জন্য

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে রামুর একচিলতে আকাশের রং ছিল লালচে। বাঙালি বৌদ্ধদের জন্য পরম বেদনার এক রাত। বৌদ্ধবিহার, শান্ত-সৌম্য বুদ্ধমূর্তি, হাজার বছরের পুরোনো তালপাতার পুঁথি, ত্রিপিটক গ্রন্থ নিজে পুড়ে সন্তুষ্ট করেছে তাদের, যারা এই দৃশ্য দেখার জন্য অনেক খেটেছে মনেপ্রাণে, আর্থিক, কায়িক, মানসিক তথা সর্বতোভাবে। গৌতম বুদ্ধের সেই পোড়া-ঝলসানো মূর্তিগুলোর চেহারায় এখনো হিংসা বা রাগের কোনো চাপ ভর করছে না। পদ্মাসনে বসা এই মূর্তিগুলো এখনো যেন বলছে, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’। যারা বুদ্ধের প্রতিমূর্তির গায়ে আগুন দিয়েছে, চোখ তুলে নিয়েছে, গলা কেটেছে, ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করেছে, হাত কেটেছে, পদদলিত করেছে, শাবল দিয়ে আঘাত করেছে এবং লুট করেছে, তাদের জন্যও সুখ কামনা রইল গৌতম বুদ্ধের।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে একে একে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল রামুর ১১টি বিহার। রামু, উখিয়া ও পটিয়া মিলে ১৯টি বিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রামু পরিদর্শন করলেন। পুড়ে যাওয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত সব বিহার তিনি পুনর্নির্মাণ করার ঘোষণা দিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বর্ষীয়ান ধর্মগুরু পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরো সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বিহার নির্মাণের জন্য অনুরোধ জানালে প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাবকে সম্মান জানান। রামুর ১১টি বৌদ্ধবিহারের মধ্যে পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে আটটি এবং সংস্কার হচ্ছে তিনটি। বিহার নির্মাণে সরকার ১২ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ভেদে তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে। ক্যাটাগরির ভিত্তিতে বিহার নির্মাণ করা হলে নিশ্চয়ই প্রদত্ত বাজেটও ক্যাটাগরি অনুসারে হয়েছে। কোন গ্রেডে কত টাকার কাজ করা হবে, সে কথা সেনা কর্তৃপক্ষ ভালো জানবে। তবে কিসের ভিত্তিতে ক্যাটাগরি বিভাজন করা হলো, সেটা আদৌ স্পষ্ট নয়।

দুই.

সেনাবাহিনী রাস্তা, সেতুসহ বড় বড় স্থাপনা নির্মাণের কাজ করে থাকলেও বৌদ্ধবিহার নির্মাণের ক্ষেত্রে এটা তাদের জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা। তাই নকশা, কাঠামো, কারুকার্য—এসব কিছুতে তাদের কিছুটা ঘাটতি থাকতেই পারে। ১৭ ইসিবির অধীনে কাজ হলেও সেনাবাহিনী আবার বৌদ্ধ স্থপতির সাহায্য নিয়েছে। ঢাকায় বসবাসরত বিশ্বজিৎ বড়ুয়াকে স্থপতি এবং সুভাষ বড়ুয়াকে কাঠামো প্রকৌশলী হিসেবে ওই কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ বড়ুয়া ঢাকায় বসে লাল চিং ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত সব বিহারের নকশা করলেন। তবে পরবর্তীকালে কিছু কিছু নকশায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে যে আদলে বিহারগুলো নির্মিত হচ্ছে, বিশ্বজিৎ বড়ুয়ার নকশায় তা অবিকল ছিল না। বিহারের সঙ্গে কয়টি অ্যাটাচ্ড বাথরুম থাকবে, সেটা যত গুরুত্ব পেয়েছে, বিহারের সীমানাপ্রাচীর ততটা গুরুত্ব পায়নি। অথচ বিহারের সুরক্ষা ও সৌন্দর্য রক্ষা দুটি ক্ষেত্রেই সীমানাপ্রাচীর গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই লাল চিং, সাদা চিং এবং মৈত্রী বিহারের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। যে কটি বাদ পড়েছে, সেই বিহারগুলোতে সীমানাপ্রাচীর আরও বেশি প্রয়োজন।

বিহার উন্নয়নে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের বিষয়টি জরুরি। বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র, আর্যবংশ বিহার, অজন্তা বৌদ্ধবিহার, জেতবন বিহারে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়নি। সীমা বিহারে যে সীমানাপ্রাচীর করা হচ্ছে, তা যথার্থ ও আশানুরূপ নয়। যুক্তি  দেওয়া হচ্ছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান খোলামেলা থাকলে ভালো। অথচ বিহার আঙিনায় যেসব বাগান সৃষ্টি করা হচ্ছে, এসব কিছুর সুরক্ষার জন্যও উপযুক্ত সীমানাপ্রাচীর দরকার। বিহারের আঙিনায় ঘাসবাগান ও ফুলবাগানের কাজ হচ্ছে, সেখানে থাকছে দর্শনার্থীরা বসে মনোরঞ্জন করার মতো ব্যবস্থা। কিন্তুু এটা মনে রাখা দরকার যে বৌদ্ধদের ধর্মীয় সব অনুষ্ঠান বিহারকেন্দ্রিক। ভাড়া করা হল, পাবলিক রাস্তার ধারে কিংবা খোলা মাঠে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় না। সংঘদান, কঠিন চীবরদান, বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপন, সম্মেলন—ধর্মীয় সব অনুষ্ঠান বিহার প্রাঙ্গণেই হয়। বৌদ্ধ ঐতিহ্য, নিদর্শন ও প্রত্নতত্ত্ব দর্শনে পর্যটক আসবেন কি আসবেন না, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয় এবং মাথাব্যথার কারণও নয়। আমাদের কাছে বিহারের সুরক্ষা ও পবিত্রতা রক্ষাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আবার বৌদ্ধবিহার দর্শনে আসা পর্যটকদের আমরা কখনো অযত্ন ও অসম্মান করিনি। নিয়ম মেনে পরিদর্শন করলেই হলো। বৌদ্ধবিহারগুলোতে স্বভাবতই নারী পূজারিরাই বেশি ভিড় করেন। পূজা, উপাসনা, ধর্মশ্রবণে নারীরাই বেশি অংশ নেন। পথচারীদের কারণে পূজারিদের বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে। তাই যতটা সম্ভব প্রয়োজনীয় সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা জরুরি ও কল্যাণকর।

এখন পূজারিদের কেউ সন্তুষ্ট নন। অবশ্য বিহার কর্তৃপক্ষ দূরদর্শী ভাবনা খাটিয়ে বিহারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাটুকু সেনা কর্তৃপক্ষের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারেনি। তাহলে হয়তো ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যান বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর অবস্থান সংশোধন করা যেত। বিহার নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধ্যমতো উঁচু ভবন নির্মাণ, ভবনে বৌদ্ধিক কারুকার্য, উঁচু সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত অবশিষ্ট বুদ্ধমূর্তিগুলো সংস্কার করা, বিহারের প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম ও আসবাব সরবরাহ—এসব কিছু হলো মুখ্য বিষয় এবং বাকি সব গৌণ। অনেক তোড়জোড় করার পরে সীমা বিহারের সামনের অংশ কারুকার্য করা হলেও অন্য কোনো বিহারে এসব কারুকার্য হচ্ছে না। বাজেটস্বল্পতা ও সময়স্বল্পতার কারণে সীমানাপ্রাচীর এবং কারুকার্য করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। অথচ সাধারণ ভবন ও বৌদ্ধবিহারের মধ্যে তফাৎ মূর্ত করে তোলে এসব বৌদ্ধিক কারুকার্য। এমন কিছু বিষয় গুরুত্ব না পাওয়ায় অবশেষে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিহারগুলো তাদের বৌদ্ধিক ঐতিহ্য ফিরে পাবে না এবং সেনাবাহিনীর মহতি নিরলস প্রচেষ্টাও পুরোপুরি সার্থক হবে না।

অথচ আমরা লক্ষ করছি, সেনা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। কিছু সেনাসদস্য শ্রমিকের চেয়েও বেশি মাত্রায় পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সীমিত সময়ে কাজ যতটুকু এগিয়েছে, তা সেনাবাহিনী ব্যতীত আশা করা যায় না। সম্প্রতি দেশজুড়ে ভবন ও নির্মাণ স্থাপনা ধসে পড়ার ঘটনা যে হারে বাড়ছে, এর মূল কারণ হিসেবে দুর্বল ও অগভীর ভিত্তি, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, ঠিকাদারি স্বেচ্ছাচারিতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আমরা লক্ষ করছি, বিহার পুনর্নির্মাণে যদিও বা ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে নির্মাণসামগ্রী ক্রয় থেকে শুরু করে কাজের সার্বক্ষণিক তদারকি পর্যন্ত সবকিছুই সেনাবাহিনী করছে। সবার বিশ্বাস, সেনাবাহিনীর কাজ এসব ভুলভ্রান্তি এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সেনাবাহিনীর বিভাগীয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং সেনাপ্রধান পর্যন্ত নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেছেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অন্তরের বিশালতা ও দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

তিন.

সেনাবাহিনী বিহার নির্মাণ করলেও বিহারে থাকবেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এবং সুবিধা ভোগ করবেন বৌদ্ধরা। সেনাবাহিনী নিঃস্বার্থ সেবা দিতে গিয়ে তাদের এই মহতি কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হোক, সেটা আমাদের কারও কাম্য নয়। বিহারের সব উন্নয়ন কার্যক্রম সেবাভোগীদের মতামত ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে হওয়া দরকার। বিভিন্ন কারণে সেবাভোগীদের উপেক্ষা করা গেলেও  সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের স্বার্থে তাদের মতামত এবং সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সরকার আমাদের যে সহানুভূতি দেখিয়েছে, এর প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা ও শ্রদ্ধা বজায় রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা আমাদের কুঁড়েঘর পুড়িয়ে দিয়ে তার বদৌলতে জৌলুশ প্রাসাদ চাই না। আমরা আমাদের কুঁড়েঘরটার নিরাপত্তা চাই।  আমরা বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়ে ক্ষতস্থানে বারবার দামি মলমও লাগাতে চাই না। রামুর এই ঘটনা যেন বাঙালি বৌদ্ধদের ওপর প্রথম এবং শেষ আঘাত হয়—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: সহকারী পরিচালক, কেন্দ্রীয় সীমা বিহার এবংকমপ্লেক্স।