বিএনপি ঠিক কাজটি করল ভুলপথে

বিএনপির ক্ষণিকের সংসদ অভিযান
বিএনপির ক্ষণিকের সংসদ অভিযান

প্রধানমন্ত্রী বলেন গণতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন এক মাস ঢাকায় সভা-সমাবেশ করা যাবে না। এটা কোন গণতন্ত্র? সরকারপ্রধানের কথা যদি তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেনে না চলেন, তাহলে সরকার চলে কার কথায়? গণতন্ত্র থাকলে সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকালে নিষিদ্ধের কথা বলে আবার সন্ধ্যায় একটু নরম সুরে বলেছেন, অনুমতি সাপেক্ষে সভা-সমাবেশ করতে হবে। এই নিয়ম তো আছেই। বিরোধী দলকে অনুমতি ছাড়া আবার কোন সমাবেশটি করতে দেওয়া হচ্ছে? তাহলে এই নতুন আদেশের মানে কী?

গণতন্ত্রের নামে এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। এর একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। গণতন্ত্রে বিরোধী দলই সেটা ভালোভাবে করতে পারে। সোমবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিএনপি যোগদান করে সে কথাই বেশ জোরেশোরে সামনে এনেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, দেশে কি অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে? এরপর তিনি ঠিক জায়গায় মোচড় দিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংসদে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানালেন।

বিএনপি ঠিক কাজটিই করেছে। সরকারের এ ধরনের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে একটা ভালো ছেঁচা (কথার) দেওয়া দরকার ছিল। ১০টা মহাসমাবেশ করেও সরকারের ওপর বিএনপি এত শক্ত চাপ দিতে পারত না, যেটা পেরেছে সংসদ অধিবেশনে বক্তৃতা দিয়ে। সারা দেশের মানুষ রেডিও-টেলিভিশনে সেটা দেখেছে ও শুনেছে। দেশে-বিদেশে সবাই বুঝেছে সরকার দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে।                     

কিন্তু মুশকিল হলো, সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েই মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে বিএনপি ওয়াকআউট করে চলে গেল। তাহলে মওদুদ সাহেবের দাবিটা কি কথার কথা? ক্ষমা চাইতে বলবেন, কিন্তু একটু সবুর করবেন না? দেখবেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে ক্ষমা চান। তাঁরা চলে গেলেন। তাহলে কি নামকা ওয়াস্তে তাঁরা সংসদে এসেছিলেন? আগেই সব ঠিক করা ছিল, তাঁরা ওয়াকআউট করবেন?

অধিবেশন ছেড়ে চলে যাওয়াটা তাঁদের ভুল হয়েছে। বিএনপির সাংসদেরা অধিবেশন কাঁপিয়ে ফেলতে পারতেন শুধু এই নিষেধাজ্ঞার ইস্যুতে। অনেক দিন পর তাঁরা অধিবেশনে এসেছেন। সরকারি দলও করতালি দিয়ে, টেবিল চাপড়িয়ে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। দেশের প্রথম নারী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তাঁদের স্বাগত জানিয়েছেন। এবার তো বিএনপির পোয়াবারো ছিল। সরকারকে আচ্ছাসে ধোলাই দেওয়ার অপূর্ব সুযোগটি তারা হেলায় হারাল। সংসদ কক্ষ ছেড়ে দিল সরকারি দলের হাতে। এখন তারা একতরফাভাবে বলে চলেছে বিএনপির মতলব খারাপ ইত্যাদি। এসব বলার সুযোগই সৃষ্টি হতো না যদি তারা সংসদের ফ্লোর আঁকড়ে থাকত। তা না, বিএনপি করে বসল উল্টো কাজ।

বিএনপির সংসদে যোগ দিয়ে সরকারকে সমালোচনায় জর্জরিত করার কাজটি ভালো ছিল, কিন্তু নিয়ত ছিল খারাপ। কারণ, অধিবেশনে যাওয়ার ঠিক আগে, বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনার জন্য দেওয়া তাদের মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। বলা হয়, ওটি নাকি ছিল বিএনপির সাংসদ মাহবুবউদ্দিনের ব্যক্তিগত প্রস্তাব। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সংসদে কোনো আলোচনা করবে না, এটাই তাদের সংসদীয় দলের বৈঠকের সিদ্ধান্ত।

বিএনপি আগে থেকেই বলছিল যে কিছু করতে হলে সরকারকেই করতে হবে, তারা অনুরোধ করলে বিএনপি এই ইস্যুতে সংসদে আলোচনা করবে। কিন্তু রোববার সন্ধ্যা থেকে আগের পরিস্থিতি বদলে গেল, যখন বিএনপি আলোচনার মুলতবি প্রস্তাব আনল। বিএনপির সাংসদ মাহবুবউদ্দিন কি দলের নির্দেশ বা অন্তত ইঙ্গিত ছাড়াই মুলতবি প্রস্তাবটি সংসদে জমা দিয়েছিলেন? কার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে বিএনপির চেয়ারপারসনের সবুজসংকেত ছাড়া এমন একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজে নিজেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন একটা কাজ করে ফেলবেন? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

আসলে বিএনপির ভেতরের টানাপোড়েনেরই বহিঃপ্রকাশ এই ঘটনা। নির্বাচনে যাব কি যাব না। সরকারি দলের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত-পা কতটা ছেঁটে ফেলা যাবে? কতটা কাটছাঁট করতে পারলে নির্বাচনে তাদের বিজয় নিশ্চিত হবে? এসব প্রশ্নে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই একবার নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে মুলতবি প্রস্তাব দেয়, আবার তুলে নেয়।

সরকার কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল ওই মুলতবি প্রস্তাব পেয়ে। কার্য-উপদেষ্টা কমিটির সভায় বিএনপির ওই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়। কিন্তু এরপরই বিএনপির সংসদীয় দলের সভায় সব উল্টে দেওয়া হলো।

এর দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, হয়তো বিএনপি দেখতে চায় ১৫ জুন চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল কী দাঁড়ায়। আর একটি কারণ হতে পারে, বিএনপি যদি নিজে উদ্যোগী হয়ে সংসদে আলোচনার প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার সুফল আওয়ামী লীগ বেশি পেয়ে যাবে কি না? কারণ, আওয়ামী লীগ আগে থেকে বলে আসছে সংসদে এসে বিএনপিকে আলোচনা করতে হবে। মাঝে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এমনও বলেছিলেন যে সংসদে বা বাইরে যেকোনো স্থানে আলোচনা হতে পারে। এমনকি সরকারি দল থেকে বিএনপিকে আলোচনার জন্য চিঠি পাঠানোর কথাও বলা হয়। কিন্তু হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির আগের দিন বিএনপি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়ার পর এবং ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটে ভেঙে দেওয়ার বিরল সাফল্য লাভের পর আওয়ামী লীগ বেঁকে বসে। তারা বলতে থাকে, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে, তবে কীভাবে হবে তা নিয়ে বিএনপি সংসদে এসে আলোচনা করুক।

এ অবস্থায় বিএনপি সুড় সুড় করে সংসদে গিয়ে আলোচনা উত্থাপন করবে, তা কী করে হয়? এতে বিএনপির মুখে চুনকালি পড়বে না? সেই মলিন ভাবমূর্তি নিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে গেলে তাদের কে ভোট দেবে?

বিএনপির এসব ভাবনার বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। নির্বাচনের আগে এমন কিছু করা যাবে না, যা তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। তাই তাদের মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবে নির্বাচনে যেতে পারলেই যে তাদের বিরাট লাভ, সেটা কে না বোঝে। তাই এখন বিএনপির এমন কৌশল নিতে হবে, যেন তাদের ভাবমূর্তি কোনোভাবেই অনুজ্জ্বল না হয়, আবার নির্বাচনেও বেশ শক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করা যায়।

অন্যদিকে, সরকারি দলকেও বুঝতে হবে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে যাওয়া মানে নিজেদের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনা। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বন্ধুবেশে এসে এসব দুর্বুদ্ধি দিতে পারে। কিন্তু ৬০ বছরের অভিজ্ঞ দল আওয়ামী লীগকে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে।

এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে কতগুলো হ্যাঁ-না ধরনের ব্যবস্থাপত্র মেনে চলতে হবে। বিএনপির জন্য অবশ্য করণীয় হলো সম্ভাব্য সব রকম সুবিধা আদায় করে নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টা করা। এ জন্য সংসদ অধিবেশনের ফ্লোর তাদের দখলে রাখা খুব জরুরি। ‘সরকারের পিলারে ঝাঁকুনি’ দেওয়ার জন্য শাপলা চত্বর বা নয়াপল্টনের মোড়ের চেয়ে সংসদ অধিবেশন অনেক বেশি উত্তম স্থান। এটা তাদের বুঝতে হবে। এগুলো হতে পারে বিএনপির জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাপত্রের হ্যাঁ-বোধক নির্দেশনা। আর না-বোধক ব্যবস্থাপত্র একটাই, সেটা হলো নির্বাচন বর্জন করা যাবে না।

অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের অবশ্যকরণীয় হলো, তোয়াজ করে হলেও বিএনপিকে সংসদে ধরে রাখা। ওরা আলোচনা না আনলেও, সরকারি দলের পক্ষ থেকে সংসদে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি কার্যকর সমাধানে আসা।

আওয়ামী লীগের জন্য একমাত্র না-বাচক ব্যবস্থাপত্র হলো, কোনো অবস্থাতেই বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা যাবে না।

এই ব্যবস্থাপত্রের হ্যাঁ-না মেনে চলা দুই দলের জন্যই কঠিন। কিন্তু কঠিন কাজটিই তাদের করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।