মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে

গত এক দশকের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তারা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছেন। তাঁদের সামনে সদা ঝুলে আছে অকালে চাকরি হারানোর খড়্গ। পদোন্নতিবঞ্চিত কিংবা ওএসডি হওয়ার দুঃস্বপ্নেও তাঁরা ভুগছেন। আর শঙ্কিত থাকেন অসম্মানজনক বা অন্যায্য পদে ও স্থানে পদায়নের ভয়ে। প্রায় সবকিছুই ঘটছে সরকারগুলোর রাজনৈতিক ইচ্ছায়। অথচ নির্বাচনকালে চারদলীয় জোট আর মহাজোট অঙ্গীকার করেছিল নির্বাচিত হয়ে তারা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রটিকে দলীয়করণমুক্ত করবে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি বলে, কেউ কথা রাখেনি। যাঁরা দলীয় আশীর্বাদধন্য হয়ে সুবিধা ভোগ করেন, তাঁরাও শঙ্কামুক্ত থাকেন না। ক্ষমতার চাকা ঘুরলে তাঁদের অবস্থাও এরূপ হতে পারে, এটা মনে করেন অনেকেই। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের মাঝে এ মনোভাব বিদ্যমান থাকলে তাঁদের কাছে যথাযথ সেবা আশা করা যায় না।

সামরিক কিংবা বেসামরিক যেকোনো চাকরিতে কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে। চাকরি লাভ করলে একজন কর্মকর্তা স্বাভাবিকভাবেই ভাবতে পারেন, কোনো অপরাধ না করলে তিনি নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে চাকরিচ্যুত হবেন না। মেয়াদকালের আগেই আকস্মিকভাবে তাঁর ছন্দপতন ঘটলে সে কর্মকর্তার গোটা পরিবার আর্থিক সংকটসহ নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়। তীব্র মানসিক চাপে পড়ে তাঁর পরিবার। সামাজিকভাবেও তাঁরা কিছুটা হেয় হন। বিধিবিধান প্রয়োগ করে চাকরিচ্যুতির সংখ্যা খুবই কম। জানা যায়, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় পুলিশে প্রথম শ্রেণীর পদে কর্মরত ৬২ জন ও জনপ্রশাসনের প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর দেওয়া হয়। আরও দুর্ভাগ্যজনক, ওই সময় রাজনৈতিক প্রভাব বলয় থেকে দূরে অবস্থানকারী সামরিক বাহিনীতে দেড় শর অধিক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, অকালীন অবসর কিংবা বরখাস্ত করা হয়। এঁরা কে কী অপরাধ করেছিলেন বা আদৌ করেছিলেন কি না, এটা আমাদের অজানা। জনপ্রশাসন ও পুলিশের চাকরিচ্যুতরা অনেকেই আদালতের আশ্রয় নিয়ে চাকরি ফিরে পেয়েছেন সে সরকারের মেয়াদ শেষে। তখন তাঁদের চাকরির মেয়াদও শেষ। বর্তমান সরকারের সময়ে জনপ্রশাসন ও পুলিশে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার বিধানটির প্রয়োগ খুবই কম। এটা ভালো উদ্যোগ। জনপ্রশাসনে এযাবৎ দুজন কর্মকর্তাকে এ দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। এ সময়কালে নির্দিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণে চারজন পুলিশ কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তবে সামরিক বাহিনীতে তথৈবচ। ১৯৭ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও অকালীন অবসর দেওয়া হয়েছে। এ সংবাদটি যখন দৈনিক প্রথম আলোয় ছাপা হয়, তখন দুজন সাবেক সেনাপ্রধানের মন্তব্য নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের একজন কে এম সফিউল্লাহর বক্তব্যে দেখা গেল ‘এই বাহিনী যেমন নিয়মকানুন মেনে চলে, তখন সবকিছু হওয়া উচিত নিয়ম মেনেই।’ অপর একজন লে. জে. (অব) মাহাবুবুর রহমান বলেছেন, সরকার বদল হলেই সশস্ত্র বাহিনীর ভেতর আতঙ্ক শুরু হয়। কিছু কর্মকর্তা অকারণে ঝরে পড়েন।... তাহলে দেখা যায়, দলীয়করণের অভিশাপটি শুধু বেসামরিক প্রশাসনকেই নয়, সামরিক বাহিনীতেও কমবেশি আছে। এটা দেশের জন্য কোনো কল্যাণ আনতে পারে না।

এবার আসে পদোন্নতিবঞ্চনা। একজন কর্মকর্তা স্বাভাবিকভাবেই আশা করবেন চাকরির ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারলে  জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সময়ান্তরে তাঁর পদোন্নতি ঘটবে। পদোন্নতির সঙ্গে মর্যাদার পাশাপাশি আর্থিক ও অন্য সুবিধাদিও সংশ্লিষ্ট থাকে। বৃদ্ধি পায় ক্ষমতা ও দায়িত্বের পরিসর। পদোন্নতি দেওয়ার সময় ওই যোগ্যতাই বিবেচিত হওয়ার কথা। এসব যোগ্যতার ঘাটতি থাকলে তাঁর পদোন্নতি হবে না, এটাও সাধারণভাবে মনে করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর ব্যত্যয় ঘটে চলছে; গত চারদলীয় জোট ও বর্তমান মহাজোট সরকারের সময়ে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত কারও কারও চেয়ে অধিক যোগ্যতার অধিকারী অনেক কর্মকর্তাই পদোন্নতিবঞ্চিত হন শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়। তাঁদের মানসিক বিপর্যয় ও সামাজিক মর্যাদা চাকরিচ্যুতদের মতোই। এরূপ ঘটেছে এবং ঘটে চলছে ভূরি ভূরি। এ ধরনের কর্মকর্তাদের কাছেও আশা করা যায় না যথাযথ সেবা। ঠিক তেমনি যাঁরা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন, তাঁরাও জানেন গণেশ উল্টালে তাঁদের ভাগ্যেও এরূপ ঘটতে পারে। সুতরাং তাঁদেরও অনেকেই আতঙ্কের মধ্যে কাটান। তবে নিত্য সচেষ্ট থাকেন দলীয় আনুগত্য প্রমাণে। তাই এসব কর্মকর্তাও জনস্বার্থে অবদান রাখার খুব কম সুযোগই পান। অধিকতর যোগ্য কর্মকর্তাদের একটি অংশকে বাদ দিয়ে কম যোগ্য ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়ে শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের নয়, জাতিকেও বঞ্চিত করা হয়। জানা যায়, গত চার বছরে সামরিক বাহিনী থেকে চাকরি ছেড়েছেন ১৬১ জন। এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে বেশ কয়েকজন চাকরি ছেড়েছেন পদোন্নতিবঞ্চনার জন্য, এমন জনশ্রুতি প্রবল।

তারপর থাকছে ওএসডি থাকার মর্মবেদনা। বিদেশে প্রশিক্ষণ, দীর্ঘমেয়াদি ছুটি ইত্যাদি কারণে কাউকে ওএসডি রাখার আবশ্যকতা রয়েছে। তেমনি রয়েছে কোনো গুরুতর অভিযোগ ক্ষেত্রবিশেষে তদন্তাধীন থাকাকালে সাময়িক বরখাস্ত না করে ওএসডি করার প্রয়োজনীয়তা। জনপ্রশাসনে অনুমোদিত পদসংখ্যার অধিক পদোন্নতির ফলে ওএসডি থাকতে হচ্ছে অনেককে। এসব কারণ ব্যতিরেকে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ওএসডি করে রাখা হচ্ছে এবং অতীত সরকারের সময়েও হয়েছে অনেকে। এখন চার বছরের অধিককাল ওএসডি আছেন এমন কর্মকর্তার সংখ্যা বেশ কিছু। এটা চলছে পুলিশ বিভাগেও। সামরিক বাহিনীতে সম্ভবত এমন অবস্থা এখনতক নেই। এসব ওএসডির বেতন-ভাতা গুনতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। সরকারি আবাসন ও প্রাধিকারপ্রাপ্তদের কারও কারও চালক ও জ্বালানিসহ গাড়ি-সুবিধার খরচও সরকারকে বহন করতে হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার তাঁদের সেবা না নিতে বদ্ধপরিকর।

অনেকেই ভেবে পান না, এমনটা কেন চলতে থাকবে। আর এভাবে চলতে থাকবে কতকাল? এমনিতেই বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ কিংবা বেসরকারি খাতে আর্থিক প্রণোদনার কারণে উচ্চশ্রেণীর মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। তদুপরি যুগবাহিত রেওয়াজ অনুসারে যে মর্যাদার অধিকারী তাঁরা ছিলেন, আজ তার অনেকটা ম্রিয়মাণ। এর মাঝেও বেশ কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী সামরিক ও বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ চাকরিগুলোতে আসতে সচেষ্ট। সামরিক চাকরিতে নিয়োগ-পর্যায়ে এবং দু-তিন স্তরের পদোন্নতিতে এখনতক মেধা ও দক্ষতাই একমাত্র বিবেচ্য—এমনটা জানা যায়। আর বেসামরিক পদে কোটার বেষ্টনীতে কোণঠাসা মেধাবীরা। সীমিত সংখ্যক সুবিধাভোগীর জন্য অধিক সংখ্যক পদ সংরক্ষিত থাকে। অনেক সময় লিখিত পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থী পাওয়া যায় না সেসব প্রাধিকারভুক্ত কোটায়। অথচ লিখিত পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করে অধিক মেধাবী কিছু কিছু প্রার্থী কোটা বেষ্টনীর চাকরিবঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। এ চাকরিগুলোর পদোন্নতিতেও আবার সূচনাকাল থেকে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। 

একটি জাতি দীর্ঘদিন এরূপ মাশুল দিতে পারবে না। তাদের করের টাকায় প্রশিক্ষণ পাওয়া ও অভিজ্ঞতা অর্জনকারী কর্মকর্তারা বিনা কারণে অকালে ঝরে পড়ুক, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না আর কাম্য হতে পারে না রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কর্মকর্তাদের মাঝে এ ধরনের আতঙ্ক চলমান থাকা। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা জাতির সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি। সে প্রতিশ্রুতির বিপরীতধর্মী কাজ করে তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে ও করে চলছে। বর্তমান সরকার বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশে অন্তত বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা কথা রেখেছে। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে তা রাখেনি। যে দলই সরকারে থাকুক বা আসুক না কেন, তারা ১৬ কোটি মানুষের অভিভাবক হয়ে যায়। সবার প্রতি সম-আচরণে তারা দায়বদ্ধ। এমনকি রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথনামায় কোনোরূপ অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দায়িত্ব পালন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। তা তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ করেন ও স্বাক্ষর দেন। সুতরাং সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্যই তাঁরা এরূপ করতে পারেন না।

তাঁরা ভুলে যান, এরূপ করে কোনো সরকারই কখনো লাভবান হয়নি। যারা তাঁদের অনুরাগী বলে অহর্নিশ বকবকম করছে, সময়ান্তরে তাদের বিরাট একটি অংশ পেছনে থাকবে না। অন্তত নিকট অতীত তা-ই বলে। গত জোট সরকারে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এখন হাড়ে হাড়ে বিষয়টি বোঝেন। বিশেষ করে বোঝেন তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। অবশ্য সময় পাল্টালে তাঁরা আবার এসব ভুলে গিয়ে একই কাজ করতে থাকবেন, এমন আশঙ্কাকেও উপেক্ষা করা চলে না। আর আজ যাঁদের অধিকারবঞ্চিত করা হচ্ছে, স্থান দেওয়া হচ্ছে না কোলে, একসময় তো তাঁদের অপমানের অংশীদার হয়ে যেতে পারেন এসব যাঁরা করেছেন ও করছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের ‘অপমানিত’ কবিতার কয়েকটি চরণে তারই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে—

মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,

সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,

অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।