ঝুঁকি আছে, নগরায়ণে চাই আরও সতর্কতা

গতকাল বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৭ মিনিটে ঢাকা শহর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্বে ভারতের মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে ভূপৃষ্ঠের ৫৫ কিলোমিটার গভীরে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এই অঞ্চলটি পৃথিবীর ষষ্ঠ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। মাত্রা ও গভীরতার বিচারে এ ধরনের ভূমিকম্পকে মাঝারি-শক্তিশালী অগভীর ভূমিকম্প বলা হয়। এই ভূমিকম্পের তরঙ্গ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাসহ নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা হতাহতের খবরও পেয়েছি। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় এই অঞ্চলকে আমরা আরাকান ব্লাইন্ড মেগা থ্রাস্ট হিসেবে গণ্য করে থাকি, যা ভারতীয় ও বার্মা ভূতাত্ত্বিক প্লেটের একটি সক্রিয় সংযোগস্থল। এই মেগা থ্রাস্ট এলাকা ৫০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে প্রলম্বিত এবং সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্য এবং বাংলাদেশের সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলা এই মেগা থ্রাস্টের অংশ।
ভূমিকম্পনের শক্তি প্রকাশের জন্য আমরা দুটি শব্দ ব্যবহার করি। একটি মাত্রা, অন্যটি তীব্রতা। ভূমিকম্পের উৎসস্থলে ভূ-অভ্যন্তর থেকে কী পরিমাণ শক্তি বের হলো, তা মাত্রার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। একটি ভূমিকম্পের একটি মাত্রা থাকে। যেমন এই ভূমিকম্পের মাত্রা ৬ দশমিক ৭। দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যক্তিবিশেষের কম্পন-অনুভূতির ওপর নির্ভর করে ভূমিকম্পের তীব্রতা নিরূপণ করা যায়।
২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সংঘটিত নেপাল ভূমিকম্পেও ঢাকা শহরে প্রায় একই তীব্রতা অনুভূত হয়েছে। এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ঢাকা শহর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে ছিল। একটি ট্রাক কোনো একটি বিল্ডিংয়ে আঘাত করলে এই তীব্রতা অনুভূত হতে পারে। যেকোনো অবকাঠামোর কম্পন সহ্য করার অবস্থা এবং মাটির দৃঢ়তার ওপর তীব্রতা নির্ভরশীল। একই মানের কাঠামো শক্ত মাটির চেয়ে নরম মাটিতে বেশি তীব্রতা অনুভব করবে। বেশি তীব্রতা মানে বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ৭ দশমিক ৪ মাত্রার বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয় ১৯১৮ সালে। এটি শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। সিলেট অঞ্চলের রশিদপুর পাহাড়ি অঞ্চল সংযুক্ত ফাটল রেখা এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল। ১৮২২ সালেও এই ফাটল রেখায় ভূমিকম্প হয়েছিল। এগুলো অগভীর ভূমিকম্প। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটারেরও কম গভীরতায় এই ভূমিকম্পগুলোর উৎসস্থল। তাই এই ভূমিকম্পগুলোকে ভাসমান ভূমিকম্প বলা হয়। সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চলে ভাসমান ভূমিকম্প সংঘটিত করার মতো প্রায় ১৩টি ফাটল রেখা আছে। এগুলো ১০০ বছর অন্তর ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। সে হিসাবে বাংলাদেশ মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার একটি ভূমিকম্পের কাছাকাছি সময়ে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আছে পাঁচটি সক্রিয় ফাটল রেখা। বাংলাদেশ সীমানার বাইরে উত্তরে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং পূর্বাঞ্চলে আছে সক্রিয় প্লেট বাউন্ডারি। ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার সব উপাদানই আছে।
ভূমিকম্প নগর দুর্যোগ নামে পরিচিত। আমাদের দেশে নগরের জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধি ও নগরায়ণ হচ্ছে দ্রুতগতিতে। যেমন ঢাকায় ১৮৭২, ১৯৭১ ও ২০১৬ সালে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা যথাক্রমে ৭০ হাজার, ১ কোটি ২০ লাখ ও ১ কোটি ৫০ লাখ। ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ আয়তন ১৯৫৪, ২০০০ এবং ২০১০ সালে যথাক্রমে ৩৬ দশমিক শূন্য, ১৯০ ও ২৬০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিশাল, বর্তমানে অন্যূন ১৬ কোটি।
২০৫১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫৫%-এর বেশি মানুষ হবে নগরবাসী, অর্থাৎ বাংলাদেশ তখন সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায় একটি নগরায়িত দেশে পরিণত হবে। দ্রুত কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য নগর ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে চলছে। উপরন্তু আমাদের নগরসমূহ নরম পলিমাটির ওপর গড়ে ওঠায় ভূমিকম্পে স্থাপনাসমূহের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এমতাবস্থায় ভূমিকম্পসহ অন্যান্য আপদের পরিমাণগত মানচিত্র তৈরি করে নগর ভূমি ব্যবহার মানচিত্রের সঙ্গে সন্নিবেশ সাপেক্ষে ঝুঁকি হ্রাস পরিকল্পনা অনুসরণ করে নগরায়ণ করা দরকার। এ বিষয়টি নগর পরিকল্পনা আইনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
১৯৯৩ সালে আমাদের দেশে বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়েছে। এটি এখন আবার নবায়ন করা হচ্ছে। কোড মেনে ভবন তৈরি করার প্রবণতা যেমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত, তেমনি সরকারি পর্যায়ের তদারকি নেই বললেই চলে। বর্তমানে খোদ ঢাকা শহরে বেশির ভাগ দালানকোঠা ভূমিকম্প তরঙ্গ সহনীয় নয়। ২০০৯ সালের পরিসংখ্যানে ঢাকায় ১ লাখ ৪০ হাজার ইট-সুরকির দালানকোঠা আছে। কলামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা নিচতলার চারপাশ খোলা সফট অ্যাস্টোরি বিল্ডিং আছে ৮৯ হাজার। নিচতলা থেকে ওপরতলা প্রশস্ত ও ভারী এমন হেভি ওভার হ্যাং বিল্ডিং আছে ৬৯ হাজার। দুটি কলামের মধ্যবর্তী স্থানে ওপরে-নিচে সংক্ষিপ্ত দেয়াল ও মধ্যখানে ফাঁকা এমন শর্ট কলামসম্পন্ন বিল্ডিং আছে ৬৮ হাজার। এসব বৈশিষ্ট্যের ভবনের ভূমিকম্পের সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বেশি।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিকম্প-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও অনুসন্ধানকাজে আমাদের অনভিজ্ঞতা, এ-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির স্বল্পতা ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, জনগোষ্ঠীর অসচেতনতা এবং সর্বোপরি আপদ-বিপদের বিচারে দেশের নগরগুলো উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। দুর্বল ও ভঙ্গুর নগর-লাইফলাইন সিস্টেম (গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি) শহরগুলোর আগুনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক দুর্যোগে বিপদের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণ। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য এখনই নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও সমন্বিত এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী গতিশীল করা সময়ের দাবি।
ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল: চেয়ারম্যান, দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।