এখন শুধু উন্নয়নের সময়!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

‘উন্নয়ন’ শব্দটি এখন যতটা শোনা যায়, ‘গণতন্ত্র’ ততটাই কম। গণতন্ত্র নিয়ে হা-হুতাশ আমাদের কমে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে ও বহু উচ্চারিত ‘গণতন্ত্র’-এর জায়গা দখল করে নিয়েছে ‘উন্নয়ন’। পদ্মা সেতুর কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে, এবং তাও হচ্ছে নিজেদের অর্থে। ঢাকায় মেট্রো রেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। যত দেরি আর ঝুটঝামেলাই হোক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হচ্ছে, হচ্ছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। ঢাকায় উড়ালসড়ক নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে তেজগাঁও, মগবাজার, বাংলামোটর, মৌচাক, শান্তিনগর, খিলগাঁওজুড়ে। শান্তিনগর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প পর্যন্ত হবে নতুন আরেক উড়ালসড়ক। হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ-আয়োজন চলছে। তিন তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের (মাতারবাড়ি, সোনাদিয়া, পায়রা) কথা শোনা যাচ্ছে। এগুলো সবই সুখবর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এত উন্নয়নের ভিড়ে গণতন্ত্র কি তবে মার খাচ্ছে? নাকি বাংলাদেশের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী (আমেরিকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ উচ্চ মাত্রায় ও ২৯ শতাংশ মধ্যম মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়) রাজনীতি, গণতন্ত্র এসব বিষয়ে আগ্রহ হারিয়েছে?
বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক ‘উন্নয়ন’ ও ‘গণতন্ত্র’ প্রসঙ্গ নিয়ে এর আগেও লিখেছি। এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তুলনামূলক রাজনীতিপাঠে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। ইতিহাস বা তথ্য-উপাত্ত ধরে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। ধনী দেশ ও প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন অনেকে। তবে এটাই স্বতঃসিদ্ধ এমন বলা যাবে না। শুধু প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র উন্নয়ন দিয়েছে এমনও নয়। গণতন্ত্র বলে কিছু নেই এমন দেশেও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের সঙ্গে টেকসই গণতন্ত্রের সম্পর্কের একটি দিক সম্ভবত সবচেয়ে পরিষ্কার ও সহজভাবে তুলে ধরেছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অ্যাডাম প্রোভুস্কি। তিনি তাঁর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউশনস অ্যান্ড ওয়েলবিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯৫০-১৯৯০ বইয়ে দেখিয়েছেন, একটি দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে জনগণের আয় একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (পেন ওয়ার্ল্ড টেবিলে ডলারে মাথাপিছু আয় ৬ হাজার ৫৫ ডলার) পৌঁছানোর পর গণতান্ত্রিক শাসনের আর কখনোই পতন হয়নি।
প্রোভুস্কির এ সিদ্ধান্তের মূল বিষয়টি হচ্ছে, একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশে যখন মাথাপিছু আয় কোনো একসময়ে সাড়ে ছয় হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র আর ঝুঁকির মুখে পড়ে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোনো অগণতান্ত্রিক দেশ বা যে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র নেই, সেখানে যদি মাথাপিছু আয় এই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে কি সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে? এমন কোনো নিশ্চয়তা কার্যত নেই। ফলে উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের এই সম্পর্কটিকে আংশিক হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। গণতন্ত্রহীন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশের মাথাপিছু আয় বহু আগেই সাড়ে ছয় হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়ন সেখানকার জনগণের জন্য গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রোভুস্কির তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা ধরে নিতে পারি যে এ ধরনের উচ্চ আয়ের দেশে এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে হয়তো তা টেকসই হবে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসন যে দেশে চেপে বসে, সেই দেশের শাসকেরা জনগণকে যেচে গণতন্ত্র দিতে যাবে কোন দুঃখে! বরং গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা যাতে জনগণের মধ্যে মাথাচাড়া দিতে না পারে, সে জন্য তারা সব সময়েই সচেষ্ট থাকে।
গণতন্ত্রের পথ থেকে কিছুটা পিছিয়ে এলেও উন্নয়নের পথে ভালোই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। নতুন বছর শুরু হয়েছে। স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, এ বছর যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে, তার মধ্যে ৩ নম্বরে থাকবে বাংলাদেশ (৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি)। এ সময় চীনের প্রবৃদ্ধির মাত্রা কমের দিকে থাকবে বলেই বাংলাদেশের কিছুটা সুবিধা হবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন মানির ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, ২০২০ সালে গিয়ে মিয়ানমার প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে ৩ নম্বরে চলে আসতে পারে, তবে তখনো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রায় বর্তমান হারই (৬ দশমিক ৭ শতাংশ) বজায় থাকবে। ফলে সামনের বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে এটা নিশ্চিত। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার। আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে ২০২০ সালের মধ্যে এই আয় দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

>উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্রকে ছেঁটেছে যেসব দেশ, সেখানে শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনই চেপে বসার নজির রয়েছে। কথিত উন্নয়নের পরও কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে সহজ পথে গণতন্ত্রে আর ফেরা হয় না

প্রবৃদ্ধির যে ভবিষ্যদ্বাণী জানা যাচ্ছে তাতে সামনের বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়েও এই দুটি দেশ বর্তমানে কাছাকাছি (মিয়ানমারের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ ডলারের কিছু বেশি) রয়েছে। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র প্রশ্নে এই দুটি দেশের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা আমরা করে দেখতে পারি। গণতন্ত্রের বিবেচনায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাস্তবতা পুরো উল্টো। দীর্ঘ সামরিক শাসন, রাজনীতিতেও সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সেনা কর্তৃত্বের এই দেশটিতে এইমাত্র সেদিন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে এখনো ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি সারা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলেও সেখানে পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত রয়েছে। কার্যকর গণতন্ত্রের দিকে যেতে দেশটিকে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
অন্যদিকে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নব্বইয়ে সামরিক ও সেনানিয়ন্ত্রিত শাসনকে বিদায় করেছে বাংলাদেশ। এরপর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহিংসতায় মাঝে বছর দুয়েকের জন্য এই যাত্রা ব্যাহত হলেও ২০০৮ সালে আবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা শুরু হয়। সেই যাত্রা হোঁচট খায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন এই নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের মানকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। আমরা দেখলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরপরই গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন প্রসঙ্গ বড় হয়ে উঠতে শুরু করে। সরকারের মনোভাবটি অনেকটা এ রকম যে, গণতন্ত্র অনেক হয়েছে, এতে এখন কিছু কাটছাঁট না হয় হোক, আপাতত আমরা উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হই।
অন্যদিকে এই নির্বাচনের এক বছরের মাথায় আন্দোলনের নামে নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপির হঠকারী কর্মসূচি ও আন্দোলনের সময় মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা সরকারকে কঠোর হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। চাপের মুখে পড়ে রাজনৈতিক অধিকার, বাক্স্বাধীনতা, নাগরিক সমাজের ভূমিকা ও ভিন্নমত। জোরদার হয় গণতন্ত্রের মানের নিম্নমুখী যাত্রা। কার্যত সবকিছুর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর সরকারের মুখে এখন কেবলই এক শব্দ, ‘উন্নয়ন’। এই বাস্তবতায় গণতন্ত্রে ছাড় দিয়ে শুধু উন্নয়ন চূড়ান্ত বিচারে কতটুকু ফল দেবে বা উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন কি না—এসব নিয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্ক থেকে আমরা অনেকেই যেন আপাতত দূরে থাকতে চাইছি। গণতন্ত্র, মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, আইনের শাসন, সুশাসন, অধিকতর বাক্স্বাধীনতা—এসবও যে ‘উন্নয়ন’, তা আমরা বিবেচনার বাইরে রাখছি।
আগেই বলেছি, গণতন্ত্রের বিবেচনায় মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়, উন্নয়নের বিবেচনায়ও বাংলাদেশে অনেক এগিয়ে। ধরে নেওয়া যায় উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে দেশটি সামনের বছরগুলোতে ভালো করবে ও বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পথে যাত্রা যদি ধারাবাহিকভাবে সামনের দিকে এগোতে থাকে আর একই সঙ্গে যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে জনগণের মাথাপিছু আয় নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে, তবে প্রোভুস্কির তত্ত্ব অনুযায়ী সেখানে একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের তাল মিলিয়ে চলা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে ছন্দপতন বা তাল কেটে গেলেই বিপদ।
মিয়ানমারের চেয়ে ‘গণতন্ত্র’ বা ‘উন্নয়ন’ দুই ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের তাল মিলিয়ে পথচলা। গণতন্ত্রে এখন ছাড়, এখন শুধু উন্নয়নে সময়—এমন ভাবনা বিপজ্জনক। যে উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ হাঁটছে তা আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করে নয়। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রে কাটছাঁটের মাত্রা বাড়তে থাকলে তাল কেটে যেতে পারে। উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্রকে ছেঁটেছে যেসব দেশ, সেখানে শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী শাসনই চেপে বসার নজির রয়েছে। কথিত উন্নয়নের পরও সহজ পথে গণতন্ত্রে আর ফেরা হয় না। যাঁরা উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রে ছাড় দেওয়ার বিষয়টিকে যৌক্তিক মনে করছেন, তাঁদের এই তাল কেটে যাওয়ার বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]