সৌদি আরব গোষ্ঠীবিবাদ উসকে দিচ্ছে

সৌদি আরব যেন ইরানের এ ধরনের প্রতিক্রিয়াই চাইছিল
সৌদি আরব যেন ইরানের এ ধরনের প্রতিক্রিয়াই চাইছিল

সৌদি সরকার যখন এই শনিবার শিয়া ধর্মবেত্তা ও রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষ শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল, তখন তারা জানত, এর ফলে তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ ইরান বিগড়ে যাবে। বস্তুত রিয়াদের রাজকীয় আদালত হয়তো এর অপেক্ষাতেই ছিল। তারা যা চেয়েছিল, সেটা তারা পেয়ে গেছে। খুব দ্রুতই সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। ইরানের বিক্ষুব্ধ জনতা তেহরানে সৌদি আরবের দূতাবাসে হামলা চালালে তার প্রতিবাদে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। পরিণতি এর চেয়েও খারাপ হতে পারে, এমনকি যুদ্ধও লাগতে পারে।
সৌদি আরব কেন এটা চায়? তার কারণ হচ্ছে, এই রাজতন্ত্র চাপের মুখে আছে। সৌদি রাজতন্ত্র প্রায় শতভাগ তেলের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের দাম পড়ে যাচ্ছে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে রিয়াদের বিশেষ স্থান হুমকির মুখে পড়েছে। আর ওদিকে সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী ইয়েমেনে যুদ্ধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের বিবাদ হলে তা যতটা না সমস্যা, তার চেয়ে বেশি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরবের রাজপরিবার খুব সম্ভবত এটাই মনে করে যে এর মধ্য দিয়ে তারা নিজ দেশের ভিন্নমতকে দমাতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের সমর্থন আদায় করতে পারবে, আর আঞ্চলিক সহযোগীদের সমর্থন পাবে। স্বল্প মেয়াদের পরিপ্রেক্ষিতে তারা হয়তো এই কাজটি করেছে। কিন্তু শেষ বিচারে দেখা যায়, এই গোষ্ঠীবাদকে উসকে দিলে চরমপন্থীরাই শক্তিশালী হবে। এই অঞ্চলটি তো এমনিতেই বিস্ফোরণমুখর, ফলে সেটা আরও অস্থিতিশীল হবে।
বিগত কয়েক দশকে সৌদি শাসকদের যখন বলির পাঁঠা দরকার হয়েছে, তখন তাঁরা সহজেই ইরান ও শিয়াপন্থীদের বেছে নিয়েছে। সৌদি রাজতন্ত্রের মধ্যে বহুদিন থেকেই ইরান ও শিয়াবিরোধী মনোভাব চাঙা রয়েছে, কিন্তু এই বিরোধিতা আজ সৌদি আরবের জাতীয় পরিচিতির মর্মমূলে স্থান করে নিয়েছে। এটা সৌদি আরবের শিয়াপন্থীদের জন্য বিপজ্জনক ব্যাপার, অথচ দেশটির ১০-১৫ শতাংশ জনগণই হচ্ছে শিয়া। শুধু তাদের জন্যই নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই এটা বিপজ্জনক।
না, সৌদি আরবের শিয়াপন্থীরা এবারই প্রথম হুমকির মুখে পড়ল না। সেই ২০ শতকের গোড়ার দিক থেকেই সৌদি শাসনের অধীনে গোষ্ঠীতন্ত্রের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। কেবল কিছুদিন আগেই সৌদি আরব বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের সমাজে স্থান করে দেওয়ার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছে। গোষ্ঠীতন্ত্রের বিপদ দূর করার জন্য তারা এ কাজ করেছে।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন করে শিয়া-সুন্নি বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে, সে সময় রিয়াদ নতুন নীতি গ্রহণ করতে শুরু করে। কিন্তু ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের ছোঁয়া লাগলে ও বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে গোষ্ঠীগত বিবাদ লাগানো ও তা জিইয়ে রাখার ব্যাপারে সৌদি সরকারের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়। সৌদি আরবের প্রতিবেশী বাহরাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা এই সুন্নি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। আবার সৌদি আরবের সংখ্যালঘু শিয়ারা রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
সৌদি শাসকেরা ইরান ও শিয়াদের ভীতিকর হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেন। সৌদি শাসকেরা ইয়েমেনের সবকিছুর মধ্যেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গন্ধ শোঁকেন। আর এ প্রক্রিয়ায় তাঁরা শুধু সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে দানবীয় রূপই দেননি, রাজনৈতিক সংস্কার ও আন্দোলনকে খাটো করেছেন। শেখ নিমর বহুকাল ধরেই সৌদি রাজপরিবারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছিলেন, কিন্তু মূলত ২০১১-পরবর্তী কার্যক্রমের জন্যই তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। শিয়াদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে স্পর্ধিত প্রতিবাদ করায় ২০১২ সালে সৌদি পুলিশ তাঁর পেছনে লেগেছিল, এমনকি পুলিশ সে সময় তাঁকে গ্রেপ্তারও করেছিল। গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ দাবি করেছিল, শেখ নিমর তাদের গুলি করেছিলেন। দাপ্তরিকভাবে দেশদ্রোহের অপরাধে শেখ নিমরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খুব সম্ভবত, ক্ষমতাকাঠামোর সমালোচনা করার জন্যই তাঁকে এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি যে উদার ছিলেন, তা নয়। কিন্তু তিনি যে ধরনের সমালোচনা করতেন, সে ধরনের সমালোচনাকে সৌদি সরকার খুব ভয় করে, আর তা একদম সহ্য করে না।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড সৌদি আরবের মিত্র ও ভবিষ্যতের ভিন্নমতাবলম্বীদের যে বার্তা দিয়েছে, তার জন্য সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে এই রাজতন্ত্রে যে শিয়াবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে, সেটা দিয়ে শুধু শিয়াদের অধিকতর রাজনৈতিক অধিকারের দাবি দাবিয়ে রাখা হয়নি। সংখ্যালঘু শিয়ারা যে গণতন্ত্রের দাবি তুলেছে, সেটা খাটো করতে সৌদি আরব তাদের অ-ইসলামি হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে। এরপর সুন্নি সংস্কারপন্থীরা যারা এত দিন শিয়াদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে, তারাও থেমে গেছে।
সংস্কারের নতুন আহ্বানের ব্যাপারে সৌদি কর্তৃপক্ষের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক সপ্তাহ আগে সৌদি সরকার বলল, ২০১৬ সালের জাতীয় বাজেটের জন্য তাদের প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি আছে। তেলের মজুত কমতে থাকায় সৌদি আরব হয়তো সামাজিক কল্যাণ খাতের ব্যয় এবং পানি, গ্যাসোলিন ও কর্মসংস্থানের ভর্তুকি কমিয়ে দিতে বাধ্য হতে পারে। কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিশিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলে তো মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে চলে যায়, অর্থনৈতিক চাপের কথা মনে থাকে না।
সৌদি আরব যে ক্রমাগত ইরান ও শিয়াবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে, তার বিপদ হচ্ছে, এটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে না। ইরাক, সিরিয়া ও অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা যায়। সৌদি আরবের বেলায় এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। সেখানে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সম্পর্কিত সন্ত্রাসীরা গত বছর বেশ কয়েকটি শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে।
সৌদিরা যে সহিংস গোষ্ঠীবিবাদ জিইয়ে রাখতে চায়, আসল সমস্যাটা মোটেও তেমন নয়। তারাও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। রাজতন্ত্রের নেতারা যেভাবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন, তাতে বোঝা যায়, তাঁদের হাতে আর তেমন বিকল্প কিছু নেই। ঝুলিতে হয়তো আরও কিছু আছে, সেই বিবেচনায় এটা অত্যন্ত ভীতিকর ব্যাপার। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে, সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে, তাদের এ ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। সেই ব্যাপারটা হচ্ছে, তারা মোটেও স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে না।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
টোবি ক্রেইগ জোন্স: রাটজার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক।