দশজনের মধ্যে নয়জনই!!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

জাতীয় নিরাপত্তার প্রথম কথা কিন্তু নাগরিকদের নিরাপত্তা। আবার নিরাপত্তা হলো নিরাপত্তার বোধ। বাংলাদেশে নাগরিকেরা নিজেদের অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার চেয়েও বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন, বিদেশি গবেষণা সংস্থার সেই রিপোর্ট ধরে এই কলামে একটা লেখা লিখেছিলাম।
তখনই প্রশ্নটা উঠল। পুলিশের কাছে গেলে প্রতিবিধান পাওয়া যাবে কি না, রাস্তায় রাতে চলতে ভয় লাগে কি না, আপনার বাড়িতে গত এক বছরে কোনো চুরিচামারি হয়েছে কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর যা পাওয়া গেছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষেরা অনেক উন্নত দেশের মানুষের চেয়ে নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মানুষ কি তঁাদের নিজেদের ঘরে নিরাপদ? আরও একটু নির্দিষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের নারীরা কি তাঁদের নিজেদের ঘরে নিরাপদ? আরও একটু নির্দিষ্ট করে বলা যায়, বাংলাদেশের একজন স্ত্রী কি তাঁর স্বামীর কাছে নিরাপদ?
এই বিষয়ে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনের ফল ভয়াবহ। বাংলাদেশে প্রতি দশটা পরিবারের মধ্যে নয়টাতেই নারীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার। সব প্রশ্নের উত্তর নাকি হ্যাঁ বা না দিয়ে হয় না। যেমন? এই উদাহরণটা তখন দেওয়া হয়, ‘আপনি কি আগের মতো বউ পেটান?’
এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি কী বলবেন? যদি বলেন, ‘না’, তার মানেটা দাঁড়াবে, আপনি আগে বউ পেটাতেন, এখন আর আগের মতো পেটান না। হয় পেটানো ছেড়ে দিয়েছেন, নয়তো পেটানোর পদ্ধতিটা বদলেছেন। আর যদি বলেন ‘হ্যাঁ’, তাহলে তো কথাই নেই। আগেও স্ত্রীকে মারতেন, এখনো মেরে চলেছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে এই প্রশ্নটা বাংলাদেশিদের বেলায় বড়ই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের নারীরা ঘরেই নির্যাতিত হন—এবং যে হারে হন, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক, তা ভয়াবহ, তা লজ্জাজনক। গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশে নিযুক্ত নয়টি দেশের রাষ্ট্রদূত, যাঁদের সবাই নারী, এই বিষয়ে একটা প্রচারণা শুরু করেছিলেন।
পারিবারিক নির্যাতনের এই হিসাবে মানসিক নিপীড়ন অন্তর্ভুক্ত আছে। কাজেই এই প্রশ্ন খুব উঠবে যে শারীরিক নির্যাতন আসলে শতকরা কত ভাগ হয়? এই প্রশ্নের উত্তরেও আপনার মাথা হেঁট হয়ে আসবে, তিনজন বিবাহিত নারীর দুজনই স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, শারীরিকভাবে। এর মধ্যে চড়-থাপড় আছে; কোনো না কোনো হাতিয়ার দিয়ে আঘাত আছে; কিল, ঘুষি, লাথি আছে; পোড়ানো আছে; অ্যাসিড ছোড়াও আছে। এঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারীকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, অনেকেই স্বামীর ভয়ে ডাক্তারের কাছে যাননি, কেউবা যাননি সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে।
তিনজনের মধ্যে দুজন বউ পেটান? আর ‘হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে’—সেটা তো আছেই। সবটা মিলিয়ে দশজনের নয়জনই বউ পেটান, হাতে বা ঠোঁটে। এই আমার বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানটা চমকে দেওয়ার মতো, ঘাবড়ে দেওয়ার মতো, আঁতকে ওঠার মতো, লজ্জায় অধোবদন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নানা ধরনের কাপড়চোপড়—শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবি-পায়জামা, লুঙ্গি-গেঞ্জি, কোট-টাই পরে আমরা পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি কতজন স্ত্রী-নিপীড়ক। কোনো বাসের মধ্যে যদি ৪০ জন পুরুষ যাত্রী বসে থাকেন, তাঁদের ৩৬ জন বউ পেটান; কোনো অফিসে যদি ১০০ জন পুরুষ সহকর্মী থাকেন, তাঁদের ৮৭ জন স্ত্রী নিপীড়ন করেন!
পরিসংখ্যানটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, না না, এটা হতেই পারে না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, তিনজনে দুজন একেবারে শারীরিকভাবেই নির্যাতন করেন! এবং এই লজ্জাজনক ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কোনো কথাও বলি না। শেষে আমাদের এই নীরবতা ভাঙতে এগিয়ে এসেছেন এই দেশে কর্মরত বাইরের দেশের নয়জন নারী রাষ্ট্রদূত! তবু আমাদের নীরবতা ভাঙল বলে তো মনে হয় না! আসলে বায়ুসমুদ্রে ডুবে থাকলে যেমন বোঝা যায় না চারদিকে বায়ু আছে, তেমনি নারী নির্যাতন–সমুদ্রে ডুবে থেকে আমরা বুঝছি না যে আমরা নারী নির্যাতন করে আসছি!
সেই যে প্রচলিত কথাটা—আপনি কি এখনো আগের মতো বউ পেটান?—কথাটার মধ্যেই কিন্তু অনেক প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে। এক. বউ আপনি ঠিকই পেটান, আগে আর পরে, আগের মতো কিংবা এখন নতুন রকমে। দুই. বউ পেটানো কথাটার মধ্যেই একটা বস্তুবাচকতার ইঙ্গিত আছে। আপনি কি ঢোল পেটান কথাটা যেমন, তেমনি রকম আপনি কি বউ পেটান? হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নাটকে একটা প্রবাদ ব্যবহার করেছিলেন, বউ আর ঢোল বাড়ির ওপরে রাখতে হয়! আমরা হয়তো এই প্রবাদটা বিশ্বাসই করি। প্রবাদ তো সমাজের বহুদিনের আচার-আচরণ থেকেই উদ্ভূত হয়!
রবীন্দ্রনাথের গল্পের কথাও তো আসবে। ‘শাস্তি’ গল্পে পাই—
‘ক্ষুধিত দুখিরাম আর কালবিলম্ব না করিয়া বলিল, “ভাত দে।”
বড় বউ বারুদের বস্তা স্ফুলিঙ্গ পাতের মতো এক মুহূর্তেই তীব্র কণ্ঠস্বর আকাশ-পরিমাণ করিয়া বলিয়া উঠিল, “ভাত কোথায় যে ভাত দিব। তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি। আমি কি নিজে রোজগার করিয়া আনিব।”
সারা দিনের শ্রান্ত ও লাঞ্ছনার পর অন্নহীন নিরানন্দ অন্ধকার ঘরে প্রজ্বলিত ক্ষুধানলে, গৃহিণীর রুক্ষ বচন, বিশেষত শেষ কথাটার গোপন কুৎসিত শ্লেষ দুখিরামের হঠাৎ কেমন একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল। ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় গম্ভীর গর্জনে বলিয়া উঠিল, “কী বললি!” বলিয়া মুহূর্তের মধ্যে দা লইয়া কিছু না ভাবিয়া একেবারে স্ত্রীর মাথায় বসাইয়া দিল। রাধা তাহার ছোটো জায়ের কোলের কাছে পড়িয়া গেল এবং মৃত্যু হইতে মুহূর্ত বিলম্ব হইল না।’

>সবটা মিলিয়ে দশজনে নয়জনই বউ পেটান, হাতে বা ঠোঁটে। পরিসংখ্যানটা চমকে দেওয়ার মতো, ঘাবড়ে দেওয়ার মতো, আঁতকে ওঠার মতো, লজ্জায় অধোবদন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট

দুখিরাম খুন করল বউকে। দুখিরামকে বাঁচাতে এগিয়ে এল তার ভাই ছিদাম। কীভাবে? নিজের বউকে শিখিয়ে দিল, পুলিশ এলে বলবি, সে দা নিয়ে তোকে মারতে এসেছিল, নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে তুই তাকে খুন করেছিস। তা-ই হলো শেষ পর্যন্ত। বউকে খুন করল দুখিরাম আর শাস্তি পেল ছিদামের বউ।
এটা আমাদের সমাজে বহুদিন ধরে ঘটে আসছে বলেই তো রবীন্দ্রনাথ এই গল্প লিখতে পেরেছেন। আমরা আমাদের প্যান্টের আড়ালে লেজটা লুকিয়ে রাখব কী করে? যতই নখ কাটি না, আমাদের নখর বেরিয়ে পড়বেই। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ধারাবাহিক নাটক ৬৯-এ ফজলুর রহমান বাবু একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী জয়া আহসান, এই অধ্যাপক বউকে পেটান না, কিন্তু হাতে একটা ছুরি রাখেন। না, বউকে মারার জন্য নয়, নিজের হাত কাটার জন্য। বউকে সন্দেহ করেন, কিছু হলেই ছুরি বের করে বলেন, কাটলাম কিন্তু নিজের হাত। ওই নাটকটা প্রচারের পরে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কাজ করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা আমাকে বলেছিলেন, এটা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের একটা ধরন, ওই যে মানসিক অত্যাচার—এটা তার মধ্যে পড়ে।
এখন এই লজ্জা থেকে আমরা মুক্তি পাব কী করে? ব্যাপারটা কেবল লজ্জার নয়, বাস্তবেও নানাভাবে ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতার অর্থনৈতিক কুফল মারাত্মক, যার মধ্যে আছে স্বাস্থ্য-চিকিৎসার খরচ, আয় হ্রাস, উৎপাদন হ্রাস, পরবর্তী প্রজন্মের ওপর নেতিবাচক মারাত্মক প্রতিক্রিয়া।
বাংলাদেশ তো মানব উন্নয়ন সূচকে অনেক ক্ষেত্রেই খুব ভালো করছে। আমাদের মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। আমরা মায়ের স্বাস্থ্য শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি ঘটাতে পেরেছি। আমাদের মেয়েরা কাজ করছেন, মাঠে-ঘাটে, সংসারে, অফিসে-আদালতে, বিমানে-ট্রেনে। তারপরেও কেন কমছে না পারিবারিক নির্যাতন? দেখা যাচ্ছে, এই সমস্যা যেমন গরিব ঘরে আছে, তেমনি আছে ধনীর ঘরে, অশিক্ষিতের ঘরে যেমন আছে, তেমনি আছে শিক্ষিতের ঘরে।
তবুও আমাদের আশাবাদী হতেই হবে। সচেতনতা সৃষ্টি থেকে শুরু করে বিচার আর সাজা—নানাভাবে কাজ করে আমরা এই ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটাতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, আমাদের দুজন বিরোধী নেতা নারী, আমাদের স্পিকার নারী। আমাদের মেয়েরা গ্রামগঞ্জে বেরিয়ে আসছেন ঘর থেকে, তাঁরা লেখাপড়া করছেন, তাঁরা কাজকর্ম করছেন।
আবারও আমি দেব রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার সাদেকার উদাহরণ। তিনি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন বেগম রোকেয়া নারী সমিতি। সেই সমিতি গ্রামের মেয়েদের হাতের কাজ শেখায়, তঁারা পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেন, হাঁস-মুরগি-গরুর চাষ করেন—সমিতি এখন বেশ ঋদ্ধ। তাঁদের গ্রামের প্রতিটা ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, সবার বাড়িতে বিশুদ্ধ পানি আছে, আছে স্যানিটারি ল্যাট্রিন। ওই গ্রামে কোনো বাল্যবিবাহ হয় না। পুরো গ্রামের প্রতিটা পরিবার এখন পাল্টে গেছে। আমি পুরুষদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মেয়েরা এত কিছু করছেন, আপনারা বাধা দেন না? তাঁরা বলেছেন, কেন দেব? এতে তো আমাদেরই উন্নতি হচ্ছে। (সাদেকা খাতুনের একটা চিঠি এসেছে দুই দিন আগে, তাঁদের সমিতি গ্রামের বাড়ি বাড়ি কম্বল দিতে চায়। কিছু কম্বল কি আমরা পাঠাতে পারি!)
আমি মনে করি, সচেতনতা সৃষ্টি করলে কাজ হবে। আমরা যদি একটা আওয়াজ তুলতে পারি, আমরা যদি নীরবতা ভঙ্গ করতে পারি, আমরা যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটা দেখতে পারি এবং প্রতিজ্ঞা করি—আগের মতো আর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স করব না—হয়তো খানিকটা কাজ দেবে।
আমরা কি সেই প্রতিজ্ঞাটা করব? আজই। এখনই?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।