নীরবে সক্রিয় বেবী আপার বিদায়

হোসনে আরা ইসলাম বেবী
হোসনে আরা ইসলাম বেবী

২২ জানুয়ারি ভোরে মোবাইলটা শব্দ করে ডাকল। সাড়া দিতেই শুনতে পেলাম নাজিয়ার কান্নাভেজা কণ্ঠ, সে জানাল, ‘খালা, আম্মু আর নেই।’ প্রাণটা ধক করে উঠল, অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালে ছিলেন বেবী আপা, তিনি আর ইহলোকে নেই।
হোসনে আরা ইসলাম বেবী আপা নামেই তিনি আমাদের প্রজন্মের সবার কাছে পরিচিত। পারিবারিকভাবে তাঁর নাম উম্মে সালমা খায়রুন্নেসা রেখেছিলেন তাঁর নানি। এমনটিই জানাল নাজিয়া, বেবী আপার প্রয়াত বোন নুরুন্নাহার ফয়জুন্নেসা আপার মেয়ে। আমরা ষাটের দশকে (১৯৬০) উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় থেকে দেখেছি ছোট্ট নাজিয়া বেবী আপাকে আম্মু বলে ডাকে। আজ সেভাবেই নাজিয়া জানাল আম্মু প্রয়াত হওয়ার খবর। ২০০৪ সালে প্রয়াত হয়েছেন তাঁর মা আর আজ প্রয়াত হলেন তার আম্মুু। বেবী আপার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি হারাল তাদের একান্ত শ্রদ্ধার-আদরের মা, নানি, দাদিকে। আমরা হারালাম একজন দরদি, দেশপ্রেমিক, সরল, বলিষ্ঠ, শান্তশিষ্ট, কোমল, শুভানুধ্যায়ী, রাজনীতি-সচেতন, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্বকে। নিজেকে গোপন-শান্ত-আড়ালে রাখার সহজলব্ধ গুণ ছিল তাঁর। উঁচু গলার স্বর তাঁর কণ্ঠে আমরা কখনো শুনিনি। নীরব সাধনায় সক্রিয় থাকার অসাধারণ গুণে তিনি অতিক্রম করেছেন তাঁর দীর্ঘ ৮৭ বছরের জীবন (১৯২৯-২০১৬)।
তাঁর কণ্ঠ শুনেছি গত মাসে, ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ। টেলিফোনে স্পষ্ট শান্ত গলায় স্নেহভরে জানালেন তাঁর নাতির বিয়ের আমন্ত্রণ। আমারও নাতনির বিয়ের উৎসব ছিল প্রায় একই সময়ে। তিনি দোয়া করলেন এবং দোয়া চাইলেন। এর বেশ আগে দুই-তিনবার তাঁর গুলশানের আবাসবাড়িতে গিয়েছিলাম। বেবী আপা ও স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে এক বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম আমি ও মতিউর রহমান। এরপর মাজহারুল ইসলাম ভাইয়ের প্রয়াত হওয়ার দিন বেবী আপাকে দেখলাম আকুল, নিঃস্ব, স্তব্ধ হয়ে থাকতে। পরে আর একদিন গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানলাম তাঁর বাল্য-তারুণ্য সময়ের কথা। আর ষাটের দশক থেকে তো আমরাই বহুজন সাক্ষাৎ জানি তাঁর প্রকাশ্য ও গোপনীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বহু কর্মকাণ্ডের কথা।
বেবী আপার সাক্ষাৎকার নিতে নিতে মনে মনে ভাবছিলাম সেই ১৯৪০-এর দশকে রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি কেমন ছিলেন? সুন্দর-স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে বালিকা বেবী বড় হলেন, উত্তীর্ণ হলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ১৯৪৫ সালে। ভর্তি হলেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। জীবনের প্রথম শোক পেলেন বাবার মৃত্যুতে। পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিয়ে হলো খালাতো ভাই মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। সেই সময় কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছিল। বেবী আপা এবং আরও বহু নারী-পুরুষ সমাজকর্মী, দেশপ্রেমিক তরুণ-তরুণী লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনার কাজে নিরলস কাজ করেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বেবী আপা চট্টগ্রামে শ্বশুরবাড়িতে এলেন, পরে স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায় এলেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারকাজে যুক্ত স্বামী ও ভাইয়ের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনিও জড়িত হয়েছিলেন। স্বামী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রগতিশীল কাজে স্ত্রী বেবী আপাকেও যুক্ত করলেন। উৎসাহ দিলেন বেবী আপাকে পড়া শুরু করতে। পুরানা পল্টন কলেজে আইএ পড়া শুরু করেন। তখন থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ১৯৬৫ সালে আইএ পাস করলেন। ভর্তি হলেন ইডেন কলেজে বাংলায় অনার্স বিষয়ে পড়তে।
এই সময় থেকে বেবী আপার সঙ্গে আমার এবং ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্রী কর্মীদের ঘনিষ্ঠ ছাত্ররাজনীতি সম্পর্ক, যোগাযোগ শুরু হলো। মহা বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম তাঁর আবাসবাড়িটি ছাত্ররাজনীতি, সংস্কৃতি সংসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপের নানাবিধ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রয়স্থল হয়েছিল নির্ভীক-সাহসী যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, স্থপতি স্বামী মাজহারুল ইসলামের উদ্যোগে-সমর্থনে-সহযোগিতায়। আমাদের সে সময়ের সব কাজের সহায় ছিলেন এই সাহসী দম্পতি।
১৯৬৬-৬৭ সালে ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচিত পুরো প্যানেলের ভিপি পদে আসীন ছিলেন বেবী আপা। সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব পুনরায় ১৯৬৮-৬৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হলেন, মিটিং-মিছিলে সার্বক্ষণিক সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের পরও পড়ায় কৃতিত্ব অর্জন করে ইডেন কলেজে সব ছাত্রীর মধ্যে হলেন প্রথম এবং সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্ব আমাদের সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের বিরাট সাফল্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
আমার মনে পড়ছে, বেবী আপাকে তাঁর বাংলায় অনার্স পড়ার সময় আমি গৃহশিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছিলাম। তিনি মনোযোগী ছাত্রী ছিলেন, পড়ার সময় বাড়ির অন্য কোনো কাজে তিনি ব্যস্ত হতেন না। বাধ্য ছাত্রীর মতো সব পড়া তৈরি করতেন। মূলত
আমি তখন আমার লেখাপড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। তাঁকে পড়ানোর কাজটি আমার প্রথম পেশাগত কাজ ছিল। তিনি আমাকে আমার বাসা ওয়ারী থেকে তাঁর বাসায় গাড়ি করে আনা-পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেসব দিনের আনন্দে-কর্মব্যস্ততায় পূর্ণ, আন্দোলনে, ত্যাগে, শৌর্যে মহান উদ্দীপনায় পূর্ণ স্মৃতির সঙ্গে বেবী আপা ও মাজহারুল ইসলাম ভাইয়ের সম্পৃক্ততা আজও উজ্জ্বল স্মৃতিভরপুর হয়ে আছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বেবী আপার ভূমিকা রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও সেবামূলক কাজের পরিসরে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক ও নারী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি নানাবিধ কাজে স্থপতি স্বামীর রাজনৈতিক আদর্শে অংশগ্রহণ করেছেন, যা সব সময় ছিল তাঁরও নিজের আদর্শ। স্বামীর রাজনৈতিক নানাবিধ ঝড়ঝাপটা তাঁর ওপর দিয়েও বয়ে গেছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।
বেবী আপা ছিলেন সবার সুখে সুখী, সবার দুঃখে দুঃখী একজন মানবিক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্ব। আমরা তাঁর যথাযথ মূল্য দিতে পারিনি বলে এখন কষ্ট পাচ্ছি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে সেই কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে চাইলাম। তবু সেটাও নিরর্থক প্রচেষ্টাই হলো। তাঁর পুরো পরিবারের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের জন্য জানাচ্ছি অকৃত্রিম সমবেদনা। তিনি থাকবেন সব কর্মকাণ্ডের যোদ্ধারূপে অমলিন।
মালেকা বেগম: অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।