শান্তিবাদী কোনির জন্য কয়েক ছত্র

হোয়াইট হাউসের সামনে অবস্থান ধর্মঘটরত শান্তিবাদী কোনির মুখোমুখি লেখক
হোয়াইট হাউসের সামনে অবস্থান ধর্মঘটরত শান্তিবাদী কোনির মুখোমুখি লেখক

আকাশ থেকে তুলার মতো তুষার ঝরছিল কখনো। তার মধ্যে হুল ফুটানো কনকনে বাতাস। কখনোবা টিপটিপে বৃষ্টি। বিচ্ছিরি আবহাওয়া যাকে বলে। তাপমাত্রা মাইনাস ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউর হোয়াইট হাউস-সংলগ্ন পার্কের মেপল, বার্চ প্রভৃতি বৃক্ষের ৯৫ শতাংশ পাতা ঝরে গেছে। ওই পার্কের কোনায় মাথার ওপরে কোনোমতে একটি তাঁবুর মতো দিয়ে তার নিচে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে।
তাঁর এই প্রতিবাদ কর্মসূচির শুরু ১৯৮১ সালের ১ আগস্ট। তখন হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা ছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান ও ন্যান্সি রিগ্যান। এই প্রাসাদের আরও কয়েকজন বাসিন্দা এসেছেন এবং চলে গেছেন। বর্তমানে বাস করছেন বারাক ওবামা ও মিশেল দম্পতি। ৩৫ বছর ধরে পার্কের মধ্যে অব্যাহতভাবে অবস্থান করছেন তিনি। পিতৃমাতৃদত্ত নাম তাঁর কনসেপসিয়ন পিসিয়োত্তো। ও নামে তাঁকে কেউ চিনত না। তাঁর পরিচিতি কোনি নামে। তাঁর যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচির অবসান ঘটেছে গত ২৫ জানুয়ারি। ওই দিন তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
কোনির যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে আমি নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন যাই ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। তাঁর তখন বয়স ৭৫-এর ওপরে। তাঁর মাথার ওপরে কয়েকটি প্ল্যাকার্ড। কোনোটিতে লেখা: লিভ বাই দ্য বোম্ব/ডাই বাই দ্য বোম্ব প্রভৃতি। তরুণ বয়সে রূপসী ছিলেন। আমি যখন তাঁকে দেখি তখন তিনি বিধ্বস্ত একটি বিল্ডিংয়ের মতো। বত্রিশটির মধ্যে দাঁত আছে মাত্র তিনটি।
আমি তাঁর যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে গেছি শুনে তিনি খুবই প্রীত হন। তাঁর সামনে একটি পিঁড়ির মতো আসনে আমি বসে পড়ি। তাঁর কর্মসূচি, জীবনদর্শন ও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে থাকি।
কোনির জন্ম স্পেনে, ১৯৩৫ সালে। শৈশবে বাবা-মাকে হারান। দাদি তাঁকে লালন-পালন করেন। দাদির মৃত্যুর পর কোনি আমেরিকা আসেন। তখন তাঁর বয়স ১৮। নিউইয়র্কে লেখাপড়া করেন। পরে নিউইয়র্কের স্প্যানিশ কনস্যুলেটে সেক্রেটারির চাকরি করেন কিছুদিন। সাধারণ মানুষের মতো ঘরসংসার, স্বামী-সন্তান নিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধাতা সে সুযোগ তাঁকে দেননি।
প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন একটি হৃদয়হীন লোকের সঙ্গে। তাঁদের কোনো সন্তান না হওয়ায় একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। এর মধ্যে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। দত্তক মেয়েটির অভিভাবকত্ব নিয়ে ও অন্যান্য বিরোধে স্বামীর সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। স্বামী তাঁকে মানসিক রোগী প্রতিপন্ন করতে নানা রকম ষড়যন্ত্র করেন। পুরুষ মানুষের থেকে প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে ওয়াশিংটন আসেন।
কোনির বন্ধু বলতে দুনিয়ায় মাত্র দুজন। একজন শান্তিবাদী উইলিয়াম টমাস এবং তাঁর কাঠবিড়ালি। পার্কে অবশ্য আরও কাঠবিড়ালি আছে। ওরা লেজ উঁচিয়ে ছোটাছুটি করে। কোনির কাঠবিড়ালিটি টুকটুক করতে করতে আমার লুঙ্গির ওপর এসে পড়ে। কুনিকে বললাম, আপনার বন্ধু আমার লুঙ্গির ভেতর ঢুকে পড়বে না তো! তিনি বললেন, না, ওরা খুব ভালো। যুদ্ধবাজ ও দাঙ্গাবাজ মানুষের মতো নয়।
কোনি ও টমাসের প্রতিবাদী সংগঠনের নাম ‘দ্য হোয়াইট হাউস অ্যান্টি-নিউক্লিয়ার পিস ভিজিল’। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রতি প্রতিবাদ। তাঁদের বার্তা খুব সহজ: চাই মানবজাতির জন্য শান্তি, মুক্তি ও ন্যায়বিচার—পিস, ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস ফর ম্যানকাইল্ড।
প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের মনিকা কেলেঙ্কারি থেকে বুশের ইরাক যুদ্ধ, লিবিয়া আক্রমণ, ওবামার যুদ্ধনীতি, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের বোমা হামলা প্রভৃতির বিরুদ্ধে ছিল তাঁর প্রতিবাদ।
কোনি শান্তিবাদী হলেও তিনি তাঁর কর্মসূচি শান্তিতে পালন করতে পারেননি। তিনি ও টমাস ৩৫ বছরে অনেকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশের মার খেয়েছেন। অনেকবার তাঁদের ওখান থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ইতরজনের ইতরামোর শিকারও হয়েছেন। আবার সহানুভূতিও পেয়েছেন শান্তিকামী মানুষের। অনেকে খাবার এনে দিয়ে গেছেন।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের মধ্যেই তাঁর জন্ম। ফ্রাঙ্কোর স্পেনেই কেটেছে তাঁর জীবনের প্রথম ১৮ বছর। যুদ্ধজনিত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে তাঁকে বললাম, সে অভিজ্ঞতা আমাদেরও রয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরাও হয়েছিলাম গণহত্যার শিকার। নারী, শিশু ও বৃদ্ধ কোনো বাছবিচার ছিল না। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে। নারীর ওপর চলেছে যৌন নিপীড়ন। তিনি স্মরণ করতে পারলেন না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা, তবে দুঃখ পেলেন শুনে, তা বোঝা গেল তাঁর মুখ দেখে।
তিনি বললেন, সব মানুষকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে বিশ্বের দেশে দেশে যে অশান্তির আগুন জ্বলছে, তার বিরুদ্ধে অহিংস উপায়ে প্রতিবাদ জানাতে পথে নামতে হবে।
তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, গান্ধীকে কি তুমি দেখেছ কাছে থেকে? বললাম, না, সে সৌভাগ্য হয়নি। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি যখন তিনি উগ্রপন্থীদের হাতে নিহত হন, তখন আমি খুবই ছোট। তবে তাঁকে না দেখলেও তাঁর অহিংস নীতি সম্পর্কে ধারণা আছে। এবং সাধ্যমতো আমি তা প্রচার করি।
বিস্ময়কর নারী ছিলেন কোনি। মাদার তেরেসার মতো হালকা-পাতলা। কিন্তু প্রাণশক্তি প্রচুর। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেই তাঁকে তাঁর কর্মসূচি থেকে সরাতে পারেনি। পৃথিবীতে পরাশক্তির পারমাণবিক বর্বরতা থাকবে না, যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না—এই তাঁর স্বপ্ন।
কোনি মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শের মৃত্যু নেই। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুদিবসে আমি সদ্য প্রয়াত কোনির স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।