নতুন মহিলা সমিতি উদ্বোধনের প্রাক্কালে কিছু কথা

আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নবনির্মিত মহিলা সমিতি মঞ্চ উদ্বোধন করতে আসছেন। একসময় এক অপরিসর, অভিনয়-অনুপযোগী মঞ্চে এ দেশের নাট্যকর্মীরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। মৌলিক নাটক ছাড়াও বিশ্বের তাবৎ নাট্যকারদের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী-নির্দেশক ও নাট্যকারের জন্ম হয়েছে এখানে। মহিলা সমিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নাটক দেখতে এসেছেন। একসময় নাটকের কেন্দ্রই ছিল এই মহিলা সমিতি মঞ্চ। বেইলি রোডের নামও হয়ে গেল নাটক সরণি। নাট্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষ নতুন মঞ্চটি নির্মাণও করেছে। আমরা সত্যিই রোমাঞ্চিত যে এই মঞ্চে আমরা আবার অভিনয় করতে পারব। এক কোটি জন-অধ্যুষিত এই বিশাল নগরে শিল্পকলা একাডেমির বাইরে আরেকটি মঞ্চও যুক্ত হলো।
সম্প্রতি আমি পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনটি মঞ্চনাটকের উৎসব উদ্বোধন করেছি। মঞ্চগুলো হচ্ছে একটি কলকাতার বেলঘরিয়ায়, অন্য দুটি অশোকনগরে ও গোবরডাঙ্গায়। লক্ষ করলাম একটা উৎসবের মৌসুম চলছে সেখানে। জেলা, মহকুমা ও থানা শহরে একেবারে সঠিক মঞ্চে বিপুল দর্শকসমাগমে এই উৎসবগুলো হচ্ছে।
প্রতিটি উৎসবে ও প্রকাশনায় কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে নাটকের সার্বক্ষণিক কর্মী। এই সার্বক্ষণিক কর্মীদের স্যালারি গ্র্যান্টও দেওয়া হয়। অসংখ্য নাট্যদলের কর্মীদের এই গ্র্যান্টের আওতায় আনা হয়েছে। প্রতি দলে ন্যূনপক্ষে ১০ জন কর্মী ও একজন পরিচালককে মাসিক বেতনও দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় সরকার ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করেছে। শম্ভু মিত্র, উৎপল দাশ ও রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্তরাও এই গ্র্যান্টের আওতায় সার্বক্ষণিকভাবে নাটকের কাজ করে গেছেন। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তাই কয়েক বছর আগে এই গ্র্যান্টের জন্য শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি অজ্ঞাত কারণে লালফিতায় বন্দী হয়ে আছে।
দেশের নাট্যচর্চার ধারা ক্রমেই ক্ষীয়মাণ হয়ে আসছে। ৪৪ বছর ধরে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। তা ছাড়া, সম্প্রচার গণমাধ্যমে কাজ করলে একজন নবাগত অভিনেতাও একটা সম্মানী পেয়ে থাকেন। ইতিমধ্যেই আমরা অনেক প্রতিভাবান অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে হারিয়েছি। তাঁরা মিডিয়ায় গিয়ে আর ফিরে আসেননি। শিক্ষক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সবাই তাঁদের কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক পান। কিন্তু একটি পয়সাও পান না নাট্যকর্মীরা। অতীতে রঙ্গমঞ্চের রূপতৃষ্ণায় অনেক অভিনেতার অকালমৃত্যু হয়েছে। দারিদ্র্য, হতাশায় সমাজের করুণার পাত্র হয়েছেন অনেকে। কিন্তু একুশ শতকে এটা কোনো অবাস্তব প্রস্তাব নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো অনেক সমৃদ্ধ নাট্যকর্মীকে দেখে থাকবেন, কিন্তু তাঁরা এখন আর মূল চালিকাশক্তি নন। তা ছাড়া, আজকের দিনে পেশাদারত্বের প্রয়োজন। আর কত দিন আমরা নাটকে অ্যামেচার কাজ দেখেই সন্তুষ্ট থাকব? রুশ ফেডারেশনে এখনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ১৪০০ থিয়েটার আছে, যেখানে সবাই বেতনভুক। ইস্তাম্বুলে ১১০টি মিউনিসিপ্যাল থিয়েটার আছে। ভারতেও প্রচুর পেশাদার রেপার্টরি আছে, যার সিংহভাগ অর্থায়ন করে রাষ্ট্র। ইংল্যান্ডে রয়্যাল শেক্সপিয়ার থিয়েটার অনেকবার দেউলিয়া হয়েছে। তারপরও রাষ্ট্র তাকে ভর্তুকি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষ নাট্যপ্রিয়। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে সর্বত্র যদি উপযোগী মঞ্চ থাকত তাহলে বিনোদনের ও শিক্ষার অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হতে পারত নাটক। মহিলা সমিতিসহ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ একই অঞ্চলে। িমরপুর, উত্তরা, পল্লবী, গুলশান, পুরান ঢাকা সর্বত্র মঞ্চ প্রয়োজন। কলকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চ আছে। মুম্বাই শহরেও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মঞ্চের সংখ্যা ৭৭। উত্তরা, িমরপুর থেকে শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে দর্শকদের আসা বর্তমানে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশত বর্ষে ভারতের অনেক জায়গায় সরকারি অনুদানে স্টুডিও থিয়েটার হয়েছে। এর মালিকানা দলগুলোর। তেমনি যদি দলগুলোকে কিছু জায়গা বা পরিত্যক্ত অথবা অর্পিত সম্পত্তি দেওয়া যায়, তাহলে নিজ উদ্যোগেই তারা মঞ্চ করতে পারবে। বরিশাল ও শ্রীমঙ্গলে নিজস্ব উদ্যোগে ইতিমধ্যে দুটি স্টুডিও থিয়েটার হয়েছে। বরিশাল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কিছু অর্থ অনুদানও পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বাইরে এসবও করা সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন আছে। এসব মিলনায়তনে শব্দের প্রতিধ্বনি এমন পর্যায়ে, যা একেবারেই শ্রব্য নয়। মঞ্চ নির্মাণেও ভুল হয়েছে এবং রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলো উপযোগী করতে হলে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। প্রতিটি শহরে অন্তত দুটি উপযোগী আধুনিক মিলনায়তন প্রয়োজন।
নাটককে যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে, মানুষ তত বেশি সচেতন হবে এবং উগ্র মৌলবাদের পথ রুদ্ধ হবে। গণমাধ্যমের অন্য সব শাখা বিভক্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তি কিছু কিছু জায়গা দখল করেছে, কিন্তু নাটকই একমাত্র মাধ্যম, যে নাটকের মঞ্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারিত হয়নি।
নাটক গণতন্ত্রের একটা বড় শক্তি। মঞ্চনাটক তো বটেই, পথনাটক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বড় ভূমিকা রেখেছে। যখন মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল তখন মান্নান হীরার পথনাটক আগুনের জবানবন্দি অমানবিকতার এক চূড়ান্ত দলিল হিসেবে দর্শকদের কাছে পৌঁছে গেছে। রাজনীতির কুৎসিত একটা চেহারা দেখেছে মানুষ।
এসব কাজে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েও ভাববার সময় এসেছে। রানী সরকারকে যদি ওই সময় প্রধানমন্ত্রী সাহায্য না করতেন, তাহলে এত দিন তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যেত না। তাই আগেভাগেই বিষয়গুলো ভাবা যেতে পারে। শিল্পীদের আবাসন ব্যবস্থা পৃথিবীর সব জায়গায়ই আছে। নামমাত্র ভাড়ায় তাঁরা সরকারি ফ্ল্যাট পেয়ে থাকেন। শম্ভু মিত্র তেমনি একটি ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন, যেখানে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি থেকেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কলাকুশলী, নাট্যকার সবাই এই সুযোগটি পান। সমাজকে যাঁরা নতুন কিছু দেন, তাঁদের জন্য তো এসবই প্রাপ্য বলে ধরা হয়। একসময় প্রধানমন্ত্রী ন্যাম ফ্ল্যাটগুলোকে শিল্পীদের দেওয়া যায় কি না, ভেবেছিলেন। পরে অবশ্য ক্ষমতার পালাবদলে তা অন্যদের হাতে চলে যায়।
বড় বড় সুপার মার্কেটে একটি করে সিনেপ্লেক্স করার কথা। সবাই কি তা মানছে? সিনেপ্লেক্সের পাশাপাশি একটা থিয়েটার তো থাকতে পারে। নাটক এমন একটি মাধ্যম, যেখানে প্রতিটি কর্মীকেই সমাজ নিয়ে ভাবতে হয়। সমাজভাবনা ছাড়া নাটক হয় না। তাই এই ভাবনাসমৃদ্ধ মানুষগুলোর কথা রাষ্ট্র ভাববে, সেটাই তো আমরা আশা করি।
মহিলা সমিতি মঞ্চ আবার খোলা হচ্ছে। অনেক অনেক স্মৃতিবিজড়িত এই সমিতির পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হবে অনেক চরিত্রের মুখ। সমস্যা একটিই—মিলনায়তন ভাড়া। ভাড়ার অঙ্ক আমাদের জন্য সহনশীল করতে হলে ভর্তুকি লাগবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিশ্চয়ই সমাধান আছে।
নাটকের মঞ্চে সত্য বারবার উচ্চারিত হোক।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।