অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতা নয়

পাঠানকোটে যা হলো তা আসলে রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। রোগটা হলো ঘৃণা, যা ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের মনে গেঁথে গেছে। ১০ বছর আগে মুম্বাই হামলার মধ্যে আমরা সেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ দেখেছি, আর এবার পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে হামলার মধ্য দিয়ে আমরা আবারও সেই ঘৃণার রূপ দেখলাম।
দেশভাগের সেই ভার এখনো আমরা বহন করে চলেছি, ১৯৪৭ সালের পর তিনটি প্রজন্ম এসেছে, তাতেও সে ভার লাঘব হয়নি। এই ঘৃণা ক্রমেই বাড়ছে, কারণ দেশ দুটির মানুষের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই।
সবার ওপরে রয়েছে পাকিস্তানের ইতিহাস বিকৃতি, তারা পাঠ্যপুস্তকে হিন্দুদের খুব বাজেভাবে চিত্রিত করে, যদিও দেশটির উদার মানুষের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সেই পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়েছে। তারপরও পাকিস্তানের ইতিহাসে মোহাম্মদ গজনবীকে গৌরবান্বিত করা হয়, যিনি কিনা গুজরাটের বহু প্রাচীন সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। এদিকে ভারতের কিছু চরমপন্থী মানুষ ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রটি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় তাঁরা তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি। তাঁরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কারণ কিছুটা হলেও তো তাঁরা সাড়া পাচ্ছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি পাঠানকোটের হামলা তদন্ত করে আক্রমণকারীদের শাস্তি দেবেন। তাঁর এই ঘোষণা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমানাহীন অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নওয়াজ শরিফের এই আত্মপ্রত্যয়কে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত। বস্তুত তিনি শান্তিকামী মানুষ, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি সফল হবেন?
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় যে পারভেজ মোশাররফের এখন বিচার হচ্ছে। পারভেজকে যে জামিন দেওয়া হয়েছে, তাতেই বোঝা যায়, নওয়াজের ওপর সামরিক বাহিনীর কতটা চাপ রয়েছে। পাকিস্তানে শেষ কথা বলার মালিক হচ্ছে সেনাবাহিনী, তারা আর যা-ই করুক, একজন সাবেক সেনাপ্রধানকে তো আর ফাঁসিকাষ্ঠে পাঠাতে পারে না, সে তাঁর অপরাধ যতই ঘৃণ্য হোক না কেন।
এতে আরও বোঝা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি সামরিক কর্মকর্তা হলে পাকিস্তানের আইন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সে জায়গায় পড়ে নেই। সামরিক বাহিনী যদি সামান্য পরিমাণেও যুক্ত থাকে, তাহলে সেসব দেওয়ানি মামলার বিচার সামরিক আদালতে হয়। সেখানে ধর্মবিরুদ্ধ কাজের বিচার করে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো, যাদের দেখভাল করার মতো কর্তৃপক্ষ নেই, এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতও ওই সব আদালতকে তত্ত্বাবধান করতে পারেন না। নওয়াজ শরিফ যদি কোনো আইনসংগত কথাও বলেন, তাহলে সেটা তাঁর সাহসিকতা, কারণ একদিকে সামরিক বাহিনী, আর অন্যদিকে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো তাঁর ওপর নজর রাখছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আচমকা লাহোর সফর করে নওয়াজের ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন। মোদি বুঝতে পেরেছেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ভারতের সঙ্গে সংলাপের বিরোধী। আর সে কারণেই ভারত-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের সূচি পুনর্নির্ধারিত হয়েছে, সেটা ভেঙে যায়নি।
এই বোঝাপড়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতেও পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব টগবগ করে ফুটছে। চরমপন্থীরা শত্রুতা জিইয়ে রেখে বাজিমাত করতে চায়। সে কারণে তারা চায় না, দেশ দুটি কাছাকাছি আসুক। এমনকি তারা কিছু কিছু মসজিদ ও মন্দিরে নারীদের প্রার্থনা করা বন্ধ করতে চেয়েছিল।
মহারাষ্ট্রের মন্দিরে নারীদের যারা ঢুকতে দিতে চায়নি, সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমার অপেক্ষাটা খুবই অপ্রয়োজনীয় ছিল। চরমপন্থী হিন্দুরা নারীদের সামনে রেখে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে, এর মাধ্যমে তারা সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে। কিন্তু সরকারের এই চরমপন্থীদের শাস্তি দেওয়া উচিত।
তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আমি দেখেছি, তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নারীরা প্রবেশ করলে পবিত্র স্থানের পবিত্রতা বিনষ্ট হবে। কেউ কেউ আবার যুক্তি দেন, ‘আমরা তাদের যথেষ্ট জায়গা দিয়েছি।’ তাদের কথা শুনে আমি যারপরনাই ভীতবিহ্বল হয়েছি, কারণ আমি বুঝতে পারি না, মন্দিরের ভেতরে নারীরা প্রার্থনা করতে পারবে না, এমন আদেশ দেওয়ার অধিকার তাদের কে দিয়েছে।
মহারাষ্ট্র সরকারও দৃশ্যত পক্ষপাতদুষ্ট। তারা বিষয়টিকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশকে তা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে। ওদিকে কেন্দ্রের মোদি সরকারও এই ভঙ্গুর যুক্তির আড়ালে গা ঢাকার চেষ্টা করছে যে আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এটা নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়। পুরুষদের মতো নারীদেরও ধর্মীয় স্থানে ঢোকার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। চরমপন্থীরা যুদ্ধটা জিতে গেছে, তারা আবারও প্রমাণ করেছে, ধর্মীয় কঠোরতা ভাঙার লড়াইয়ে তারা জিতে যেতে পারে।
সৌভাগ্যবশত, এই বিষয়ে কিছু শহরে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু সেটা এতই সীমিত ছিল যে তাতে বোঝা যায়, মন্দিরে নারীদের প্রার্থনা করার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। আমি জানতে পেরেছি, মসজিদেও নারীরা নামাজ পড়তে পারেন না। যেমন মুম্বাইয়ের বিখ্যাত আলী মসজিদে নারীদের ঢোকা বারণ।
কয়েক বছর আগে এক কান্নাড়া (দক্ষিণ ভারতীয়) চলচ্চিত্র অভিনেত্রী বলেছিলেন, তিনি কেরালার এক মন্দিরে দেবতার মূর্তি স্পর্শ করেছেন। এরপর যেন ধরণিতে নরক নেমে এল, সেই দেবতার ভক্তরা খেপে গিয়ে এককালের সুন্দরী অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। কেরালার উচ্চ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছিল, যদিও আদালত ছয় বছর পরে তা ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন।
বস্তুত, ভারতের আরও কিছু মন্দিরে নারীদের ঢোকা বারণ। এর মধ্যে রয়েছে হিমাচল প্রদেশের বাবা বালক নাথ মন্দির, রাজস্থানের প্রভু কার্তিক মন্দির ও আসামের প্রভু সাত্রা মন্দির। অনেক আগের কথা, তবু আমার এখনো মনে আছে, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একজন পারসিককে বিয়ে করেছিলেন বলে তাঁকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
একই ব্যাপার ঘটেছিল কর্ণাটকের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী কে জে ইয়েসুদাসের বেলায়, তাঁকে বিখ্যাত গুরুভায়ুর মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, যদিও তিনি নিজেই শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, যেখানে সাবেক ইউনিয়নমন্ত্রী বায়েলার রবির নাতির অন্নপ্রাশনের পর মন্দিরকে শুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, শিশুটির দাদি খ্রিষ্টান ছিল। শিশুটির মা ও বাবা দুজনেই হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও এ কাজ করা হয়েছিল!
এসব উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, দেশে যে অসহিষ্ণুতার আবহ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে, তা বোঝানো। জাতিকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।