আইন-জগতের ধ্রুবতারা

সাবেক এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম
সাবেক এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম

১৯৫৩ সালের উচ্চমাধ্যমিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম ও তৃতীয় হয়েছিলেন যথাক্রমে কামাল হোসেন ও মাহমুদুল ইসলাম। এর অর্ধ শতাব্দী পরে এ দুজনকে আমরা দেখি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় লন্ডনের মাটিতে লড়াই করছেন। স্থান আন্তর্জাতিক সালিস আদালত (আইসিএসআইডি)। শেভরন বলেছে, পেট্রোবাংলাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটা যে অমূলক তার পক্ষে যিনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আইনি যুক্তিজাল বিস্তার করেন, তিনি মাহমুদুল ইসলাম (দলপ্রধান হলেন ড. কামাল হোসেন)। কামাল হোসেন বলেছেন, তাঁর যুক্তি আন্তর্জাতিক আদালত পুরোপুরি গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ জিতে যায়, আর তাতে পেট্রোবাংলার ২৫০ মিলিয়ন ডলারের সাশ্রয় ঘটে।
আমাদের এই মাহমুদুল ইসলাম জাতীয় বিচার প্রশাসনে বিরাট শূন্যতা তৈরি করে গত সোমবার মধ্যরাতে চলে গেলেন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজকে দল-দূষণের ঊর্ধ্বে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একজন। কী করে আইন আর দলের বিভাজনরেখা মেনে চলতে হয়, তিনি ছিলেন তাঁর অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টে এসেছেন। সর্বত্র ত্রস্ত ভাব। প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলে আদালতের প্রতিবেশী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে হাজির। কিন্তু খোদ অ্যাটর্নি জেনারেলকে দেখা গেল তাঁর প্রাত্যহিক নিয়মে কোনো পরিবর্তন নেই। ভাবলেশহীনভাবে তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ে বাসায় যেতে দেখা গেল। শশব্যস্ত হয়ে কেউ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যধারার মধ্যে এখানে তাঁর কোনো অংশগ্রহণ তিনি দেখেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগেই তিনি তল্পিতল্পা গোটাতে সতর্ক থাকেন। আর কারও কিছু বলার আগেই তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ ত্যাগ করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন স্মরণ করলেন যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঠিক হলো, আমরা দলীয় বিবেচনায় আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেব না। তখন যদিও হাইকোর্টে মাহমুদুলের পাঁচ বছর হয়নি, তবু তাঁকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নেওয়া হলো। আরেক সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু জানালেন, অ্যাটর্নি জেনারেল হতে সম্মত হলে তাঁকে নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাই। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিয়োগ দিলে আমি আমার দায়িত্ব সততার সঙ্গে সংবিধান অনুযায়ী পালন করব। আমি কিন্তু আওয়ামী লীগ করি না। আমাকে যখন আপনাদের পছন্দ হবে না, আমি চলে যাব।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর মুখের ওপরে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আওয়ামী লীগ করতে হবে না। আপনি থাকবেন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। আর তাতেই আমি খুশি থাকব।’
তিনি ছিলেন বিচার ও আইনি জগতের এক সত্যিকারের ধ্রুবতারা। গত কয়েকটা দশক তিনি জ্বলজ্বলে ছিলেন। মৃত্যুর আগে নিউমোনিয়ায় কাবু হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি লিখেই চলেছিলেন। সাংবিধানিক ও দেওয়ানি আইন নিয়ে তিনি যে তিনটি বই দিয়ে গেছেন, তা তাঁকে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। ১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশের পরে তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ-এর দুটি সংস্করণ বের হয়েছে। অথচ দুই দশক পরও আর এমন মানের বই চোখে পড়েনি। জমিজমাসংক্রান্ত দেওয়ানি মোকদ্দমা যে দেশের বিচারের প্রাণ, সেখানেও তিনিই নায়ক। দুই খণ্ডে ল অব সিভিল প্রসিডিউর লিখে গেছেন। বিশিষ্ট আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী ছিলেন সহলেখক। তাঁর তৃতীয় বই ইন্টারপ্রিটেশন অব স্ট্যাটেটিউটস অ্যান্ড ডকুমেন্টস। আর মৃত্যুর কারণে অসমাপ্ত থেকে গেল এস্টপল আইনবিষয়ক বইয়ের পাণ্ডুলিপি। তাঁর পরিণত বয়সে প্রধান বিচারপতি (১৯৭৮-৮২) কামাল উদ্দিন হোসেন তাঁকে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন। দুই বছরের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ প্রাপ্ত ইসলাম ৯ মাসে এলএলএম করে ফিরে আসেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘এস্টপল অ্যাগেইনস্ট গভর্নমেন্ট’ বা সরকারের জন্য বাধানিষেধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করেছিলেন তিনি। তারপর আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করতে গিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। সেটা ১৯৬০ সাল, দেশে আইয়ুবের শাসন। রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন তিনি। এরপর নীলফামারীতে অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন। আইনজীবী পরিবারের সন্তান হিসেবে আদালতই ছিল তাঁর নিয়তি। প্রথমে যোগ দেন রংপুর বারে, যেখানে তাঁর প্রপিতামহ মো. আশরাফ উদ্দিন এবং তাঁর পিতা আজিজুল ইসলাম আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মামা ন্যাপ নেতা আজিজুল হক স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন। গোড়া থেকেই সংবিধানের দিকে তাঁর বিশেষ নজর পড়ে। গত চার দশকে অষ্টম সংশোধনী, পঞ্চম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনীসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক মামলায় তিনি অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন। তরুণ সহকারী হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দিন তাঁকে আপিল বিভাগে নিয়েছেন সেই ১৯৭৪ সালেই। দালাল আইনে দণ্ডিতদের মধ্যে যাঁদের আপিল হাইকোর্ট গ্রহণ করেছেন, তাঁরা জামিন পাবেন কি না, সেই প্রশ্নে হাইকোর্ট বলেছিলেন যে জামিন পাবেন। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে তাঁরা জিতলেন। হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত রদ হলো। ১৯৭৫ সালের মার্চে এক আটকাদেশের মামলায় তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ টি এম আফজালের (পরে প্রধান বিচারপতি) সঙ্গে ১০২ অনুচ্ছেদের আওতায় হেবিয়াস কর্পাসের এক মামলায় তাঁকে লড়তে দেখা যায়। তাঁর আইনি লড়াইয়ের ফলে বহু আইনে সংশোধনী এসেছে। ১৯৭৭ সালে ড. নুরুল ইসলামের মামলা এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। চাকরিতে কারও ২৫ বছর হলেই বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে না রাষ্ট্র। এটা হতে হবে ‘জনস্বার্থে’।
ইনডেমনিটি আইন বাতিলের মামলায় তিনি বললেন, আইন খুনিদের ‘কায়েমি অধিকার’ দেয়নি, তাই তা হরণেরও প্রশ্ন নেই। প্রতিকারের পথে বাধা তৈরি করা হয়েছিল, সেটা সরানো হলো মাত্র। তাঁর এই যুক্তিই টিকে গেল। পিলখানা বিদ্রোহের পরে প্রশ্ন দেখা দিল কোন আইনে বিচার হবে। সেনা আইনে নয়, বাহিনীর নিজস্ব আইনে, তাঁর মতই টিকল। সাংবিধানিক ও দেওয়ানি আইনে আমাদের বিচার বিভাগের তিনি ধ্রুবতারা। তাঁর সিভিল প্রসিডিউর বইয়ের সহলেখক প্রবীর নিয়োগীর কথায়, ‘সংবিধান ও সিভিল আইনে “হি ইজ দ্য বেস্ট, ওয়ান অ্যান্ড অনলি”। তিনি বিবেক ও সংবিধান নির্দেশিত পথে চলেছেন।’
আদালতের অনিয়মে ব্যথিত ইসলাম তাঁর একটি বইয়ে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি কী করে অসাধু বেঞ্চ কর্মকর্তাদের সমর্থন করেছিলেন, তা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছেন হাইকোর্ট যাতে দরখাস্ত ছাড়া সুয়োমোটো রুল জারি না করেন। চেয়েছেন একজন রিকশাচালকও যাতে সাদা কাগজে রিট দরখাস্ত করতে পারেন। ২০১২ সালে তিনি অকপটে বইয়ের মুখবন্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের শর্ট অর্ডারকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের বিলম্বকে ‘অত্যন্ত বিরক্তিকর’ এবং দীর্ঘ রায় লেখাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে মত দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে আদালতে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। সে কারণে বাতিল হওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে দুই মেয়াদে নির্বাচন করার সুযোগ আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চে অনুমোদন পেয়েছিল। সরকার ১৫ তম সংশোধনী কমিটিতে তাঁকে সদস্য রেখেছিল। কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। 
অনেকের মতো আমি তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলাম। শেষ দিনগুলোতে তাঁকে আশাবাদী দেখিনি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কতিপয় ভালো কাজের প্রশংসা করার পাশাপাশি তিনি বলেছেন, এসব সংস্থা আজ ‘ট্রিগার হ্যাপি’। তিনি লিখেছেন, ‘সপ্তদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ দার্শনিক থমাস হবস এমন একটি সমাজের ছবি এঁকেছিলেন, জীবন যেখানে “অপ্রীতিকর, পাশবিক ও স্বল্পায়ুর”। বিচারবহির্ভূত খুনগুলো আইনের শাসনের মূলোচ্ছেদ করে, যা আমাদের হবসের সমাজে ধাবিত করতে পারে।’ আমরা তাঁর সতর্কবাণী ভুলব না। জাতি তাঁকে ভুলবে না। তাঁর শূন্যতা অপূরণীয়। তাঁর নীতি ও আদর্শ অনুসরণীয়। তিনি ছিলেন মৃদুভাষী, সদালাপী এক স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব। পেশাগত নৈতিকতা সুরক্ষা ও দুস্থের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার বিরল। সবার কাছ থেকে সব অবস্থায় সমান ফি নিয়েছেন। একবার যৎসামান্য ফি দিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি মামলা জিতে তাঁকে তা–ও ফেরত দিলেন। বিস্মিত লোকটির কাছে তাঁর কৈফিয়ত ছিল, ‘যদি আগে টাকা না নিতাম আর হারতাম, তাহলে আপনি হয়তো ভাবতেন বিনা টাকায় করেছিলাম বলে মামলায় হার হলো কিনা।’ প্রচারবিমুখ মাহমুদুল ইসলাম আজীবন গোপনে দান করে গেছেন। রংপুরের ডায়াবেটিক সোসাইটিকে কিছুকাল আগে তিনি ১০ লাখ টাকা এবং এর আগে প্রথম আলোয় এসে রানা প্লাজা তহবিলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন। শর্ত ছিল এটা প্রকাশ করা যাবে না। এলাকার মেধাবী দরিদ্র ছাত্রদের বৃত্তি দিতেন। এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে স্বর্ণপদক দিলেও স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো জাতীয় স্বীকৃতি তাঁর মেলেনি। হাসপাতালের শয্যায় বিচারপতি এম এ মতিন তাঁকে বলেছিলেন, আপনি ইংল্যান্ডে ব্ল্যাকস্টোন, আমেরিকায় হোলমস আর ভারতে জন্ম নিলে সিরভাই হতেন। আমরা তো আপনাকে কিছুই দিতে পারিনি। তিনি মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, আমার কাজে সাধারণ মানুষ যদি উপকৃত হয়, সেটাই হবে আমার স্বীকৃতি।
তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]