চিকিত্সা বনাম উপশম

আমরা অনেক রোগ প্রতিরোধ করতে পারি, আরও অনেক অনেক রোগের চিকিত্সাও করতে পারি। কিন্তু জীবনে এমন এক মুহূর্ত আসে, যখন রোগ প্রতিরোধযোগ্যও নয়, চিকিত্সাযোগ্যও নয়। এমন মুহূর্ত অনেক মানুষের জীবনে আসে। আমাদের শরীর এমনভাবে তৈরি যে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন তার টিকে থাকার একটা সীমা আছে। শরীর সেই সীমা যখন অতিক্রম করে যায়, আমরা তাকে বলি মৃত্যু। শরীরকে টিকিয়ে রাখার সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও চূড়ান্ত বিজয় মৃত্যুরই। আকস্মিক মৃত্যু ছাড়া বার্ধক্যের কারণে, কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে শরীর যখন সেই অন্তিম মুহূর্তে এসে পৌঁছায়, তখন আমাদের কী করণীয়? বহুকাল চিকিত্সাবিজ্ঞান এ ব্যাপারটার দিকে মনোযোগ দেয়নি।
মৃত্যু চিকিত্সাবিজ্ঞানের শত্রু। মৃত্যুকে মোকাবিলা করার জন্য কিউরেটিভ মেডিসিন, প্রিভেনটিভ মেডিসিন ইত্যাদি নানা বিদ্যা চিকিত্সাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হয়। কিন্তু এও তো সত্য যে মৃত্যুর সঙ্গে এই যুদ্ধের ফলাফল সবার জানা। মৃত্যু নামের এই শত্রু জীবনের চেয়ে বরাবর শক্তিশালী এবং চূড়ান্ত বিজয় হবে তারই। এমন একটা পর্ব আসবে, যা ‘আনপ্রিভেন্টেবল’, ‘ইনকিউরেবল’। সেই মুহূর্তটা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের। আমি নিজে মেডিকেলের ছাত্র। মৃত মানুষের শরীর কেটেছি কিন্তু আমাদের টেক্সট বই মৃত্যু নিয়ে বিশেষ কিছু বলে না। মৃত্যু ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে ঘটে তার কিছু শারীরবিদ্যাসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু যে মানুষটা মৃত্যুর মুখোমুখি তার অভিজ্ঞতায় ব্যাপারটা কেমন, আসন্ন মৃত্যুর মুহূর্তে তার কী চাহিদা, একজন ব্যক্তির মৃত্যু তার আশপাশের মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করছে—এসবের দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞান বহুকাল নজর দেয়নি।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তিম মুহূর্তে যখন মানুষ চিকিৎসা-অসাধ্য স্তরে গিয়ে পৌঁছায়, তখন সে মূলত চায় উপশম। চায় তার শারীরিক ব্যথার উপশম, চায় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কগুলোর বোঝাপড়া করতে, চায় নিজের স্মৃতি, জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে, এই নিশ্চয়তা চায় যে যারা পেছনে রয়ে গেল, তারা যেন ভালো থাকে, চায় এমন একটা বোধে পৌঁছাতে যে তার জীবনটা পূর্ণ হয়েছে, চায় তার বিষয়-সম্পত্তির একটা সুষ্ঠু বণ্টন, যারা বিশ্বাসী তারা চায় সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে একটা নিবেদনের সম্পর্ক। কিন্তু একজন মৃত্যুপথযাত্রীর এই চাহিদাগুলো পূরণে বহুকাল ব্যর্থ ছিল চিকিত্সাবিজ্ঞান। চিকিত্সাবিজ্ঞান শুধু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম করেছে এবং যখন তা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মানুষের অধিকার, রোগীর অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নের সূত্র ধরে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর অধিকারের ব্যাপারটাও চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলোচিত হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। অন্তিম মুহূর্তে যথাযথ সেবার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক মৃত্যু মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার দেওয়ার দাবিও উঠছে। সেই সূত্র ধরেই বিভিন্ন দেশে কয়েক দশক ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভেতরই গড়ে উঠেছে একটি শাখা বিদ্যা, যাকে বলা হচ্ছে ‘প্যালিয়াটিভ কেয়ার’। একে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘উপশমবিদ্যা’। অবস্থা যখন চিকিৎসার অযোগ্য, মৃত্যু যখন নিশ্চিত, তখন কী করে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির শারীরিক ও মানসিক উদ্বেগগুলোর উপশম ঘটিয়ে তার অন্তিম দিনগুলোকে সহনীয় করা যায়, এই বিদ্যার মূল লক্ষ্য সেটাই।

>ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের আলাদা একটা ইউনিট খোলা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও কিছু কিছু সংগঠন শুরু করেছে পেশাদারি প্যালিয়াটিভ কেয়ারের কাজ

পৃথিবীর নানা দেশে চিকিৎসকেরা এখন প্যালিয়াটিভ কেয়ারের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। তাঁরা শিখছেন কী করে আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি একজন মানুষের রোগ নিরাময়ের চেষ্টা না করে বরং কী করে তাঁর শারীরিক কষ্টগুলোকে ধাপে ধাপে কমিয়ে তোলা যায়, কী করে তাঁকে সেই সব সহায়তা দেওয়া যায়, যাতে তিনি ওই মুহূর্তে তাঁর মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলোকে যথাসম্ভব মোকাবিলা করে সম্মানজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। সেই সঙ্গে তাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কী করে তাঁর পরিজনকেও এই মৃত্যুকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা যায়। এই সম্মিলিত পরিষেবাই ‘প্যালিয়াটিভ কেয়ার’, যা হাসপাতালের গণ্ডির ভেতর হতে পারে, হতে পারে বাড়িতেও।
প্যালিয়াটিভ কেয়ার ব্যাপারটা আমাদের দেশে এখনো সাধারণ মানুষ এমনকি চিকিত্সকদের মধ্যেও তেমন পরিচিত নয়। কোনো চিকিৎসায় যখন আর কাজ হচ্ছে না, তখন যেন আর কিছু করার নেই। চিকিৎসক জবাব দিয়ে দিয়েছেন এই যেন শেষ কথা। আগে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শুশ্রূষার নানা আচার ছিল। সব শুশ্রূষা যে ঠিক পথে হতো তা নয়। কিন্তু যৌথ পরিবারে শয্যাশায়ী কোনো মানুষকে পরিচর্যার লোক মিলেই যেত। কিন্তু পরিবারের সেই কাঠামো ভেঙেছে, গ্রামে, শহরে। মানুষের কাজের ধরন পাল্টেছে, ব্যস্ততা বেড়েছে। ফলে এখন বাড়িতে শয্যাশায়ী কোনো মানুষের শুশ্রূষা হয়ে উঠেছে অত্যন্ত জটিল। তাই কঠিন রোগে আক্রান্ত শয্যাশায়ী মানুষ কোনোরকম সেবা না পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। শহরে হয়তো ঘরে অনেক ক্ষেত্রে শয্যাশায়ী রোগীদের সেবা দিচ্ছেন অপেশাদার, আনাড়ি লোকেরা। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের কেউ কেউ চড়া দামে ঘরে পেশাদার সেবাদানকারী রাখছেন।
আর অন্তিম মুহূর্তে হাসপাতালে গেলে বহু রোগীরই ঠাঁই হচ্ছে ‘নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র’ বা আইসিইউতে। আইসিইউ অনেক ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই জীবনদায়ী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তেমন রোগীকেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আইসিইউতে এবং সেখানে রেখে দেওয়া হয় দিনের পর দিন। তারপর হাসপাতালের বিছানায় এই রকম নানা টিউব আর যন্ত্রপাতির জটাজালের ভেতরই মৃত্যু ঘটে তার। এই রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া আদৌ যৌক্তিক কি না—এমন একটা যান্ত্রিক মৃত্যু সেই রোগী বা তার পরিজনের আদৌ কাম্য ছিল কি না, সেসব বিবেচনা না করে নেহাত শেষ চেষ্টার নামে অনেক সময় রোগীর অন্তিম দিনগুলোকে ওই আইসিইউর গুমোটে কাটাতে বাধ্য করা হয়। আর সেই সময় রোগীর পরিজন তাঁর রোগীকে আইসিইউতে রাখবেন কি রাখবেন না এ নিয়ে এক চরম নৈতিক এবং মানসিক সংকটের ভেতর থাকেন।
আর প্রিয়জনের জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর বাড়তে থাকে লাখ লাখ টাকার হাসপাতাল বিল, যার পরিণতিতে বহু পরিবার হয়ে পড়ে দেউলিয়া। অথচ এই রকম জটিল নাজুক মুহূর্তে চিকিৎসকদেরই উচিত রোগীর পরিজনকে রোগের সঠিক অবস্থাটা জানিয়ে তঁাদের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা। বিশেষ করে নিরাময় অসম্ভব রোগী, বা ইররিভার্সেবল কেসকে আইসিইউতে না এনে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের আওতায় আনাটাই নানা দেশের রেওয়াজ। কিন্তু আমাদের দেশে সে চর্চা সচরাচর দেখা যায় না। এর একটা কারণ অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাই প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়টা সম্পর্কে অবগত নন। তবে অজ্ঞতার কারণ ছাড়াও দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে আইসিউকে বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যখন জগৎ-সংসারের সবকিছু পণ্য হয়ে পড়ে, তখন ‘মৃত্যু’ও হয়ে পড়ে মুনাফা লোটার ক্ষেত্র। মৃত মানুষকে আইসিইউতে রেখে ব্যবসা করার ঘটনাও ঘটেছে এ দেশে।
তবে আশার কথা হচ্ছে প্যালিয়াটিভ কেয়ার বিষয়টা সম্পর্কে ক্রমে সচেতন হচ্ছেন এ দেশের মানুষ। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্যালিয়াটিভ কেয়ারের আলাদা একটা ইউনিট খোলা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও কিছু কিছু সংগঠন শুরু করেছে পেশাদারি প্যালিয়াটিভ কেয়ারের কাজ। বার্ধক্য এবং মৃত্যু যাতে অন্যায় বাণিজ্যের কবলে না পড়ে, সবার অন্তিম মুহূর্ত যেন সম্মানজনক হয়, তার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন সবারই। চিকিত্সাবিদ্যার পাশাপাশি তাই উপশমবিদ্যারও প্রসার ঘটা উচিত দেশে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
[email protected]