ইতিহাসের দায়মোচনে ঐতিহাসিকরায়

তাঁদের অনেকগুলো অভিযোগ, যেমন ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে ছাড় দিয়ে দেওয়া, ৪০ বছর পর বিচার শুরুর অসংগতি কিংবা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার কনভেনশনের সঙ্গে ১৯৭৩ সালের আইনের সাংঘর্ষিক দিক—এসব অভিযোগ নিরসনে বিজ্ঞ আদালত ইতিহাসের অনেক তথ্য-প্রমাণ-উদাহরণ তুলে ধরে যেভাবে এগিয়ে চলছিলেন, তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে একাত্তরের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে যথাযোগ্যভাবে মোকাবিলার উদাহরণ জাতি এখন সৃষ্টি করতে যাচ্ছে।

বেলা দুইটায় যখন রায় পাঠ শেষ হলো, তখনকার মানসিক আলোড়ন বলে বোঝানো মুশকিল। বিচারে অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত হলে দণ্ডাদেশ প্রদত্ত হবে, কিন্তু বিচারের চূড়ান্ত লক্ষ্য তো শাস্তি নয়, লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায়, সত্য ও মানবিকতার প্রতিষ্ঠা এবং এই লক্ষ্য অর্জনে আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে মানবসমাজের আয়ুধ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো পথ খুঁজে ফিরছে, গণহত্যার ভয়ংকরতা তো প্রচলিত আইন দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আদালত বারবার উচ্চারণ করছিলেন ডায়াবলিক্যাল আট্রোসিটিজ, বাংলায় সেই ভয়ংকরতা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত শব্দ আমাদের খুঁজে ফিরতে হয়। রায়ে আরও বলা হয়েছিল, এমন ধরনের অপরাধ কখনো এক ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হয় না, থাকে আরও অনেক সহযোগী এবং সেই মাত্রার অপরাধ সংঘটনে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি বা গুরুদায়িত্ব থাকে কোনো কোনো ব্যক্তির।

আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন দায়ভার-বহনকারীদের বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয় অপরাধী হিসেবে, তারা ঘটনাস্থলে থাকুক বা না থাকুক, ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার ধরন ও গুরুত্ব এখানে বিশেষভাবে বিবেচ্য।

আদালতে সরকারপক্ষের কৌঁসুলিরা অন্য কতক আন্তর্জাতিক আদালতের উদাহরণ দিয়ে এ ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি প্রদান করেছেন, বিজ্ঞ আদালত সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ও আইনগত ব্যাখ্যা হাজির করলেন মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের দায়ভার নির্ণয়কল্পে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে প্রদত্ত সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির এই ব্যাখ্যা এখন অনেক দেশের জন্য উদ্ধৃতিযোগ্য হয়ে উঠবে।

এমনিভাবে অভিযোগ ও সওয়াল-জবাব ধরে ধরে রায়ের ব্যাখ্যা প্রদত্ত হচ্ছিল এবং পরতে পরতে আইনের শক্তিমত্তা সৃজনশীলভাবে ফুটে উঠছিল। দূর মফস্বলের এক কলেজশিক্ষককে যে লাঞ্ছনা ও অপমান করা হয়েছিল একাত্তরে, তা আদালত গ্রহণ করলেন ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে, যে অপরাধের ধরন উল্লেখ করে ১৯৭৩ সালের আইনে সবশেষে লেখা হয়েছিল, ‘এবং আর সব অমানবিক কর্মকাণ্ড’।

প্রচলিত আইনে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করার গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো নৃশংসতা যখন ঘটে ব্যাপকভাবে, তখন যে কত ধরনের অমানবিক ঘটনার অবতারণা হয়, কে তার হদিস করবে, সংজ্ঞাই বা আগে থেকে কীভাবে নির্ধারণ করবে? আদালত যখন অধ্যাপক আবদুল হান্নানের ওপর কৃত অত্যাচারকে চিহ্নিত করলেন ‘আদার ইনহিউম্যান অ্যাক্ট’ হিসেবে, তখন আইনের ধারা বাস্তব সংজ্ঞার এমন উদাহরণ তৈরি করল, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারে দেশে দেশে আবারও অনুরণিত হবে।

আইনের ভাষায় প্রদত্ত রায় যে কত হূদয়-সংবেদী হতে পারে, সেটা বোঝা গেল যখন শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে সংঘটিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে রায় প্রদান করছিলেন আদালত। যৌন নির্যাতনের শিকার স্বামীহারা তিন নারীর আদালতে সাক্ষ্যদানের বর্ণনা আদালত দিয়েছেন স্বল্প কথায়, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আইন বুঝি সেই পরম বেদনাকে স্পর্শ করার অভিপ্রায়ী হয়েছিল। আর আমার মনে পড়ছিল কত নিষ্ঠুর ছিল সেই আঘাত, যে গোটা এক পল্লি সোহাগপুর রাতারাতি বিধবাদের গ্রাম হিসেবে নতুন পরিচয় ধারণ করল। সেই নারীদের ট্রমা বা নিরন্তর যন্ত্রণার উল্লেখও ঘটল রায়ে।

বাংলাদেশের গ্রাম ও নদীর নামে কত না বৈচিত্র্য, মানুষের কী বিপুল ভালোবাসা ও শুভাকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে থাকে তাদের দেওয়া এই সব নামে। গ্রামের নাম যারা রেখেছিল সোহাগপুর, তারা বুঝি পল্লিবালাদের প্রতি হূদয়ের সবটুকু শুভকামনা পুরে দিতে চেয়েছিল সেই নামে। আজ ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে আছে সেই গ্রাম, একই সঙ্গে ৪০ বছর পর হলেও সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সাক্ষী হয়ে উঠল এই গ্রাম।

ন্যায় ও সত্যের কল্যাণ-স্পর্শে, অগণিত মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বিধবাদের গ্রাম আবার হয়ে উঠবে সোহাগপুর, সেটাই ঘোষিত হয়েছে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের জন্য এ এক ঐতিহাসিক রায়, মানবতার বিজয়গান যেন ধ্বনিত হলো আদালতকক্ষে।

আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল যেন আন্তর্জাতিক মানের হয়, এমন হা-হুতাশ ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক মানের জন্য যাঁরা এতকাল হাহাকার করে ফিরেছেন, তাঁদের উচিত এই রায়ের পাঠ ফিরে ফিরে নেওয়া, তাহলে বোধগম্য হবে কীভাবে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো নৃশংস আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের নতুন মাত্রা তৈরি করল।

মফিদুল হক: লেখক। so-ansi1�ts@y0wt;font-family:SolaimanLipi;mso-ascii-font-family: "Sulekha Sundar";mso-hansi-font-family:"Sulekha Sundar";mso-bidi-language:BN'>বছরের শুরু থেকে নানা কর্মসূচি পালনকালে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামি সংগঠনগুলোর কর্মীদের ওপর পুলিশের ব্যাপক গুলিবর্ষণের নানা ঘটনা ঘটেছে। এসব কর্মসূচি কখনো কখনো অত্যন্ত সহিংস ছিল, কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের ওপর বর্বর আক্রমণের কিছু ঘটনাও ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়োজন ছাড়াই পুলিশি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর বা ঢাকার শাপলা চত্বরের মতো কিছু ঘটনায় পুলিশি অভিযানের যৌক্তিকতা ও তীব্রতা নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।

এসব ঘটনার সঙ্গে ভবিষ্যতে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার বা আসার লক্ষ্যে মাঠ পরিস্থিতির ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ রাখার রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এমনকি সাভারে রানা প্লাজায় হূদয়বিদারক গণমৃত্যুর ঘটনাও হয়তো ঘটত না, যদি সেদিন সেখান থেকে হরতালবিরোধী মিছিলের আয়োজনের চিন্তা সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে কাজ না করত। কোনো না কোনোভাবে এসব মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক  সরকার ও বিরোধী দলের বেপরোয়া ও সংঘাতমূলক রাজনীতি দায়ী। এই রাজনীতির উপসর্গই মৃত্যু, ধ্বংস, নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা।

এই পরিস্থিতির আশু অবসান প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি যে দেশের দুটো প্রধান গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বহুলাংশে দূর হবে। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সহায়ক আন্দোলন তাতে দুর্বল হয়ে যাবে, হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের পেছনে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক মদদও অনেকাংশে  হ্রাস পাবে। ক্রমাগত হরতাল ও পুলিশি অভিযানে ইতিমধ্যে সমাজে নানা অসন্তোষ, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হলে হরতাল ও বিরোধী দলের প্রতি দমনমূলক কর্মকাণ্ডও হ্রাস পেতে বাধ্য।

সমঝোতার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব প্রশংসনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। সর্বদলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, এ নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে কি না, তা আওয়ামী লীগকে আগে বলতে হবে। ১৯৯৬ সালে অনুরূপ পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মানতে রাজি হয়নি। কাজেই আওয়ামী লীগও এখন আশা করতে পারে না যে আগামী সর্বদলীয় সরকারের প্রধানহিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নেবে বর্তমান বিরোধী দলগুলো।

তা ছাড়া বাংলাদেশে সরকার পদ্ধতি এমনই যে সরকারপ্রধান এখানে প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ পদে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হিসেবে দলীয় কোনো নেতা (বিশেষ করে হাসিনা বা খালেদার মতো পরাক্রমশালী কোনো নেতা) দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সবচেয়ে জরুরি। তা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কোনো অবসান ঘটবে না দেশে।

রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার দ্বন্দ্বেও প্রাণ হারাচ্ছে বা সর্বস্বান্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ, সমাজের ওপরতলার কেউ নয়। দেশের মানুষকে ও দেশকে ভালোবাসলে তাই আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান দল দুটোকে করতেই হবে।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়।