'অন্তর্ধান' এবং তিস্তাপারের বাস্তব জীবন

ভাটির দেশের অনুমোদন ছাড়া ভারত আইনসম্মতভাবে একক সিদ্ধান্তে তিস্তায় পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারে না
ভাটির দেশের অনুমোদন ছাড়া ভারত আইনসম্মতভাবে একক সিদ্ধান্তে তিস্তায় পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারে না

ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে। সেখান থেকে কোনো আশাবাদ শোনা যায়নি।
১৭ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তিস্তা নিয়ে শিগগিরই কোনো অগ্রগতি না থাকায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ তেমন আগ্রহী নয়। কারণ, পাঁচ বছর বিরতির পর জেআরসির বৈঠক হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তিস্তার প্রসঙ্গ আসবে। কিন্তু দুই দেশই বুঝতে পারছে, এ মুহূর্তে তিস্তা নিয়ে চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।’
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে, এই মার্চ মাসে তিস্তায় পানি নেই বললেই চলে। শুধুই ধু ধু বালুচর। ভারত একক সিদ্ধান্তে জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ প্রবেশমুখে তিস্তার পানিপ্রবাহ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে বিপজ্জনক হারে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রবেশমুখে আমরা পেতাম ৬,৭১০ কিউসেক পানি। কিন্তু ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আমরা পেয়েছি একই পয়েন্টে যথাক্রমে ৩,৫০৬, ২,৯৫০, ৫৫০ ও ২৩২ কিউসেক পানি। এ কারণে উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলজুড়ে এর ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। তিস্তার পানি দ্বারা অন্য যেসব নদী পুষ্ট হতো, সেগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে।
তিস্তার এই করুণ অবস্থা দেখে আমার মনে পড়ে গেল খ্যাতনামা চিত্রনির্মাতা ও পরিচালক সৈয়দ অহিদুজ্জামান নির্মিত একটি অসাধারণ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কথা—অন্তর্ধান। পদ্মাপারের মানুষ সৈয়দ অহিদুজ্জামান বাঁধের কারণে প্রমত্ত পদ্মার শুকিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে নদীর অন্তর্ধানকে প্রসঙ্গ করে পদ্মাপারের মানুষের জীবনযন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলেছেন। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, পদ্মার মতো কি তিস্তাও অন্তর্ধানের অপেক্ষায় রয়েছে?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান নিম্নবর্গের শোষিত, বঞ্চিত মানুষের জীবনকথা সিনেমার পর্দায় তুলে ধরার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এই পরিচালক আগে গঙ্গাযাত্রা ছবিটির জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (নভেম্বর ২০১৩ সাল), দিল্লিতে জাগ্রন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (আগস্ট ২০১৩) ও সিঙ্গাপুরে দর্পণ চলচ্চিত্র উৎসবে (সেপ্টেম্বর ২০১৪) অন্তর্ধান প্রদর্শিত হলে বহু দর্শকের মনে দাগ কেটেছিল। অন্তর্ধান মানে যা একদা ছিল এখন আর নেই। হারিয়ে গেছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা একটা করুণ কাহিনির মধ্য দিয়ে দেখাচ্ছেন, কীভাবে একটা নদীও হারিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় নদীর ওপর নির্ভরশীল গরিব শ্রমজীবী মানুষের জীবনে যে সামান্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, সেটাও।
পরিচালক বিশাল প্রমত্তা পদ্মা নদীর হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। পদ্মার সেই বিশালত্ব আর নেই। উন্মত্ত জলতরঙ্গের বদলে রয়েছে শুধুই ধু ধু বালু। রবীন্দ্রনাথের পদ্মা আজ বোধ হয় শুধুই কল্পকাহিনি। প্রমথনাথ বিশীর পদ্মা উপন্যাসের এক জায়গায় পদ্মার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রলয়ের সহোদরা, কালনাগিনী।’ তবে প্রমত্তা পদ্মার কেবল ধ্বংসাত্মক চিত্রই তার পুরো চিত্র নয়। পদ্মার অববাহিকা অঞ্চল হয়ে ওঠে শস্য-শ্যামলা। নদীতে মাছ আসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবের মাঝির মতো কয়েক লাখ মৎস্যজীবী জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের কারণে পদ্মাপারের মানুষের জীবনে যে দারুণ দারিদ্র্য নেমে এসেছে, অন্তর্ধান চলচ্চিত্রে তারই চিত্রায়ণ রয়েছে।
মূল কাহিনির পাশে একটি ছোট কাহিনিও আছে। অনেকটা রূপক আকারে। নদী নামের একটি দরিদ্র ঘরের বালিকা (ওয়াহিদা সাব্রিনা এই বালিকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০১৪ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে) এবং আকাশ নামের একটি তুলনামূলক ধনী পরিবারের ছেলে বালুচরে খেলা করে। বিস্তীর্ণ বালুচরে একটা পানির রেখা দেখা যায়। বালু খুঁড়ে ছোট্ট একটি জলাশয় বানিয়েছে খেলার ছলে দুই খেলার সাথি। হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা মাছ লাফিয়ে উঠল। বালিকা ‘নদী’ মাছটিকে ক্ষুদ্র জলাশয়ে আশ্রয় দিয়েছিল। দুই বালক-বালিকার মধ্যে মাছ, সেই সামান্য জলাশয় ও বাঁধ নিয়ে যে ছেলেমানুষি দ্বন্দ্ব, তা ছিল এক প্রতীকী ব্যাপার। নদীর পানি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়টি কৌশলে তুলে আনা হয়েছে রূপকের আকারে।
তবে ভালো কথা এই যে কলকাতা ও দিল্লিতে এই ছবি প্রদর্শিত হলেও সেখানে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, বরং প্রশংসিত হয়েছিল। স্টেটসম্যান পত্রিকা মন্তব্য করেছিল, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পানি নিয়ে পুরোনো বিতর্ক বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় চিত্রায়িত হয়েছে।’
খেলার সাথি দুই বালক-বালিকার ছোট্ট কাহিনি সম্পর্কে পত্রিকাটির মন্তব্য, ‘নদীর বুকে খেলাধুলা করার সময় তারা এক বাঁধ নিয়ে ঝগড়া শুরু করে, যেটা তৈরি করা হয়েছে নালায় পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এই ঝগড়া শিশুতোষ হলেও তার রূপক মূল্য আছে। এটা দর্শকদের মনে করিয়ে দেয়, ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প নিয়ে বহু দিন ধরেই বিতর্ক চলছে।’ আরেকটি বিখ্যাত পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া ছবিটি প্রসঙ্গে যে প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল, তার শিরোনাম ছিল, ‘মানুষের দুঃখ নিয়ে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তা পেয়েছে’।
ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চিত্রনির্মাতা অহিদুজ্জামান বলেছেন, ‘এ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়; ভারতের সমস্যা, বিশ্বের অন্য দেশেরও সমস্যা। এ ছবি তাই সব দেশের, বিশেষত নদীর নিম্ন অববাহিকায় থাকা দেশগুলোর সমস্যা। সেখানে নদী গ্রাস করার মতো স্বার্থান্বেষীরাও রয়েছে। আগামী দিনের সংকটকে কেউ ভাবছে না। তাদের ভাবাতেই এই ছবি।’
এই ছবিটি পরিবেশবাদীরাও ব্যবহার করতে পারেন। বাংলাদেশও কাজে লাগাতে পারে। লাগানো উচিতও। এর মধ্যে বিরোধী নয়, বরং নদীর পানির ব্যবহারে সহযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত।
ফারাক্কায় যখন বাঁধ নির্মিত হয়, তখন আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে একটা সমঝোতামূলক চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বেশ শীতল ও তিক্ত হয়ে ওঠায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরকালে অত্যন্ত কাব্যিক ভাষায় যা বলে গেছেন, তা আমাদের উৎসাহিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, নদীর পানি, পাখি ও বাতাস কোনো সীমানা মানে না।
উপরন্তু, তিস্তার পানির ন্যায্য অংশীদারত্ব কেবল মানবিক নয়, আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে অধিকারও বটে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যে নদী কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল, তার ধারাবলে (বিশেষ করে ৭.১ ও ৭.২ ধারা) ভাটির দেশের সঙ্গে সমঝোতা না করে উজান দেশ নদীর পানি অন্যত্র সরাতে পারবে না। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভোটাভুটির সময় বাংলাদেশ এর পক্ষেই ভোট দিয়েছিল (১৯৯৭ সালের ২১ মে)। ভারত ও পাকিস্তান বিরত ছিল। চীন, তুরস্ক ও বুরুন্ডি বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। তবে এটিকে আইনে পরিণত করতে হলে পরবর্তী সময়ে ৩৬টি দেশের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। আগে ৩৫টি দেশ স্বাক্ষর দিলেও একটি স্বাক্ষর বাকি ছিল ২০১৪ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের সুস্পষ্ট স্বার্থ জড়িত থাকলেও এত বছরেও বাংলাদেশ কেন স্বাক্ষর দেয়নি, সেটি একটি রহস্যজনক প্রশ্ন। এমনকি যে বিএনপি নদীর পানির হিস্যা নিয়ে ভারতবিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলে রাজনীতিতে বাজিমাত করতে চায়, তারাও ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু প্রয়োজনীয় স্বাক্ষরটি দেয়নি বা ভুলে বসে ছিল। ২০১৪ সালে ভিয়েতনাম ৩৬ নম্বর স্বাক্ষরটি দেওয়ার পর এটা এখন আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে।
তাই ভাটির দেশের অনুমোদন ছাড়া আইনসম্মতভাবে ভারত পারে না তিস্তায় পানি একক সিদ্ধান্তে প্রত্যাহার করে নিতে। আমাদের সরকারের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সেটা উভয় দেশের জন্য কাম্যও বটে। অতএব সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক আইনকে কাজে লাগিয়ে তিস্তার পানিবণ্টনে ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। পদ্মার মতো আরেকটি নদীর অন্তর্ধান আমরা দেখতে চাই না। নদী হয়ে উঠুক দুই দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক। সেই জন্য ভারতের দর্শক, সিনেমা সমালোচক ও সাংবাদিকদের এত প্রশংসা পেয়েছিল এই চলচ্চিত্রটি।
* হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।