নারী লাঞ্ছনার পক্ষে মন্ত্রী শাজাহান খানের সাফাই!

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে নারীদের আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন, সেখানে তাঁরই মন্ত্রিসভার একজন সদস্য প্রকারান্তরে নববর্ষের অনুষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনাকারীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, কোটি কোটি মানুষের দেশে ওই রকম টুকিটাকি ঘটনা নাকি ঘটতেই পারে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়তে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। তবেই মর্যাদা পাওয়া যাবে। কেঁদে কেঁদে ফিরলে মর্যাদা কেউ হাতে তুলে দেবে না, বরং করুণা করবে। করুণা নিয়ে মেয়েরা বাঁচতে পারে না।’
আর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘সংগ্রামী নারী সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলেছেন, ‘পয়লা বৈশাখ আমাদের বাঙালি জাতির জীবনে বছরের প্রথম দিন। এই পয়লা বৈশাখে অনেক মানুষ রাস্তায় থাকে। এই কোটি কোটি মানুষের দেশে ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ থাকে। তার মধ্যে এমন কী ঘটনা ঘটেছে, যা সংবাদ হওয়ার মতো? একটা টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে। এতগুলো মানুষের মধ্যে এটা তেমন কোনো বিষয়ই না।’ ( প্রথম আলো, ৯ মার্চ ২০১৬)

১০ জন সংগ্রামী নারীকে সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ‘নতুনধারা’ নামের একটি সংগঠন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেখানে মন্ত্রী যে নতুন ধারার বক্তব্য রাখলেন, সেটি গিনেস বুকে স্থান পাওয়ার মতো। সংগ্রামী নারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনাকারীদের সাফাই গেয়ে এ ধরনের বক্তব্য এর আগে কেউ দিয়েছেন বলে জানা নেই।
শাজাহান খানের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা হলো, বছরের প্রথম দিন যেহেতু অনেক মানুষ রাস্তায় থাকে, সেহেতু মেয়েদের ওপর তাঁর ভাষায় ‘টুকিটাকি ঘটনা’ ঘটতেই পারে। তবে তিনি মনে করেন যে সেই ‘টুকিটাকি ঘটনা’ খবর হওয়ার মতো বিষয় নয়। মন্ত্রীর কথা মেনে নিলে গত পৌনে দুই বছর ধরে নববর্ষের প্রথম দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংঘটিত টুকিটাকি ঘটনার খবর প্রচার করে গণমাধ্যম গর্হিত অপরাধ করেছে। এটি সরকারের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। আর পুলিশ বিভাগ যে নারী লাঞ্ছনাকারীদের ধরতে লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সেটিও ছিল অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। যে টুকিটাকি ঘটনা খবর হওয়ারই যোগ্য নয়, সেই ঘটনায় পুলিশ বিভাগ কেন পুরস্কার ঘোষণা করবে? এখন মানহানির মামলায় না পড়তে চাইলে উচিত হবে তাদের সেই খবর ও ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেওয়া। টুকিটাকি ঘটনা নিয়ে জাতির এতটা সময় ও মেধা নষ্ট করা মোটেই ঠিক হবে না। এর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা সম্পর্কে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘ও কিছু না, ছেলেরা একটু দুষ্টুমি করেছে।’ মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য পরস্পরের পরিপূরকই বটে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী অতীতে যানবাহনের চালকদের লাইসেন্স দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, রাস্তায় গরু-ছাগল চিনলেই হলো। অর্থাৎ, চালকদের আইনকানুন জানার প্রয়োজন নেই। শুধু গরু-ছাগল চিনলেই তাঁরা লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। সেটা ছিল সড়কে দুর্ঘটনার অবাধ লাইসেন্স। আর এবারে নারী লাঞ্ছনাকারীদের পক্ষে সাফাই গাইলেন। নৌপরিবহনমন্ত্রীর এই বক্তব্য কেবল নববর্ষে লাঞ্ছিত কিংবা অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত ১০ নারীর প্রতিই অপমানজনক নয়, দেশের সব নারীর জন্যই অপমানজনক।